সৈয়দ সাজ্জাদ আলী (জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে সুপরিচিত সাংবাদিক)
বইমেলা বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে খোলা প্রাঙ্গণে সারি সারি বইয়ের স্টল এবং মেলা প্রাঙ্গণ জুড়ে অসংখ্য মানুষের আনাগোনা। কিন্তু আজকের ইন্টারনেটের যুগে যেখানে এক ক্লিকেই নিজের পছন্দমতো বই হাতের মুঠোয়, সেখানে বইমেলার প্রাসঙ্গিকতা কতটা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যদিও প্রকাশনার ক্ষেত্রে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে বইমেলা। বইমেলা প্রকাশক, এজেন্ট, ডিস্ট্রিবিউটর, খুচরা বিক্রেতা এবং বইপ্রেমীদের একটি প্ল্যাটফর্মে একত্রিত করে। এই বইমেলার মাধ্যমেই লেখকরা তাদের অনুরাগীদের সাথে দেখা করার এবং প্রকাশকদের সাথে মজবুত সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ পান।
কিন্তু, এই ডিজিটাল যুগে, বইমেলার গুরুত্ব কতটা? লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, পৃথিবীর অধিকাংশ বইমেলার আয়তন সঙ্কুচিত হয়ে এলেও মেলায় আগত মানুষের উপস্থিতি এবং বই কেনাবেচার নিরিখে বইমেলা আজও স্বতন্ত্র। যে যুগে প্রতিটি বই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে জায়গা করে নেওয়ার জন্য লড়াই করছে, সেখানে বইমেলা
প্রকাশকদের তাদের নিজস্ব বইয়ের তালিকা প্রদর্শনের সুযোগ দেয়। পাশাপাশি বইমেলায় পাঠকরা বইয়ের মাধ্যমে তাদের পছন্দের বই কিনতে পারেন, যা তারা অনলাইনে নাও পেতে পারেন। বই কেনাবেচার পাশাপাশি শিক্ষামূলক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কেন্দ্রও বটে বইমেলা। প্রদর্শক এবং দর্শনার্থীদের মেলার প্রতি আকর্ষণ বাড়ানো এবং জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বইমেলার আয়োজকরা মেলা প্রাঙ্গণেই সেমিনার, প্যানেল আলোচনা, উপস্থাপনা, লেখক বৈঠক ইত্যাদিরও ব্যবস্থা রাখেন। তাছাড়া, বইমেলায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডও রয়েছে, যা দর্শনার্থীদের জন্য অন্যতম আরেকটি আকর্ষণ। বইমেলা সব বয়সের মানুষের মধ্যে পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করে। অনেক স্কুলও তাদের ছাত্রছাত্রীদের বইমেলায় নিয়ে আসে, যেখানে শিশুরা তাদের পছন্দমতো বই কিনতে পারেন। বইমেলা আসলে বইপ্রেমীদের জন্য স্বর্গস্বরূপ। বইমেলা প্রকাশনা শিল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এবং আগামীদিনেও থাকবে।
ইন্টারনেট এবং বই দুটি তুলনামূলক শব্দ। কারণ উভয়ই মূল্যবান তথ্য প্রদান করে। কিন্তু এই দু'য়ের তথ্য প্রদানের জন্য নেওয়া সময়ের তুলনা করলে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ইন্টারনেটের সাথে আমাদের পরিচিতির আগে যেকোনও তথ্য সংগ্রহের জন্য বই-ই ছিল একমাত্র মাধ্যম। আগে যেকোনও তথ্যের জন্য আমরা লাইব্রেরীতে যেতাম। কিন্তু লাইব্রেরীতে যাওয়ার ব্যাপার এখন অতীত। কারণ, গোটা লাইব্রেরী এখন ইন্টারনেটের আকারে আমাদের হাতের মুঠোয়। ইন্টারনেট এবং বই দুটোই আলাদা উৎস কিন্তু আগের প্রজন্ম এখনও বই পড়তেই পছন্দ করেন।
ইন্টারনেট বইয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করেছে কারণ এর মাধ্যমে এক ক্লিকেই ইতিহাস থেকে শুরু করে সাহিত্য, শিক্ষা, বিনোদন সব আমাদের হাতের মুঠোয়। ইন্টারনেটকে এখন তথ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং প্রতিদিন এর পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। ইন্টারনেট বিশ্বের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে।
তবে, বই-এর গুরুত্ব কিন্তু প্রাচীনকাল থেকেই। যখন কাগজের আবিষ্কার হয়নি তখন থেকেই পন্ডিত ব্যক্তিরা লেখার জন্য পাথর, পাতা এবং কাপড় ব্যবহার করতেন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সেগুলো সংগ্রহ করে রাখতেন। কিন্তু কাগজ আবিষ্কৃত হওয়ার পর বই হয়ে ওঠে তথ্য ও বিনোদনের জনপ্রিয় উৎস। আজও কিন্তু একটা বড় অংশের পাঠক ইন্টারনেট নয়, বই পড়তেই পছন্দ করেন। আর এর জন্য বইমেলা হচ্ছে সেই স্থান যেখানে পাঠক তাদের পছন্দমতো বই কিনতে পারেন। তাই বইমেলা আজও তার স্বাতন্ত্রতা বজায় রেখেছে।
0 মন্তব্যসমূহ