আগরতলা: গন্ধগোকুল বিড়ালের মত বন্যাপ্রাণী, যা এশীয় তাল খাটাশ, ভোন্দর, লেনজা, সাইরেল বা গাছ খাটাশ নামেও পরিচিত। তালের রস বা তাড়ি পান করে বলে তাড়ি বা টডি বিড়াল নামেও ডাকা হয়। এই প্রাণীটিকে একসময় ত্রিপুরা রাজ্যেও প্রচুর সংখ্যায় দেখা যেত বলে অভিমত গ্রামীন এলাকায় বসবাসরত প্রবীণ মানুষদের। মূলত গ্রামীণ এলাকার ঝুপঝাড় এবং জঙ্গল এদের বাসস্থান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি ত্রিপুরা রাজ্য থেকেও কমছে এই প্রাণীটি। এই প্রাণীটি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে জঙ্গলের কমে যাওয়া খাদ্য সংকট ইত্যাদিকে দায়ী করছেন সচেতন মানুষ। জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার জন্য এই প্রাণীটিকে বাঁচিয়ে রাখার আহ্বান পরিবেশ সচেতন মানুষদের।
গন্ধগোকুল বর্তমানে অরক্ষিত প্রাণী হিসেবে বিবেচিত। পুরোনো গাছ, বন-জঙ্গল কমে যাওয়ায় দিন দিন এদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) মতে পৃথিবীর বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় উঠে এসেছে এই প্রাণীটি। আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রজাতির গন্ধগোকুলের বাস।
এরা মাঝারি আকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী। নাকের আগা থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত ৯২-১১২ সেন্টিমিটার, এর মধ্যে লেজই ৪৪-৫৩ সেন্টিমিটার। লেজের দৈর্ঘ্য ৪৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। আকার ৫৩ সেন্টিমিটার। ওজন ২.৪-৫.০ কেজি। স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষে গন্ধগ্রন্থি থাকে। গন্ধগোকুলের গাট্টাগোট্টা দেহটি স্থূল ও রুক্ষ বাদামি-ধূসর বা ধূসর-কালো লোমে আবৃত।
গন্ধগোকুল নিশাচর। খাটাশের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে এরাই মানুষের বেশি কাছাকাছি থাকে। দিনের বেলা বড় কোনো গাছের ভূমি সমান্তরাল ডালে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে, লেজটি ঝুলে থাকে নিচের দিকে। মূলত ফলখেকো হলেও কীটপতঙ্গ, শামুক, ডিম-বাচ্চা-পাখি, ছোট প্রাণী, তাল-খেজুরের রসও খায়। অন্য খাদ্যের অভাবে মুরগি-কবুতর ও ফল চুরি করে। এরা ইঁদুর ও ফল-ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে কৃষকের উপকার করে। গন্ধগোকুলের ধূসর রঙের এই প্রাণীটির অন্ধকারে অন্য প্রাণীর গায়ের গন্ধ শুঁকে চিনতে পারার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে। প্রায় পোলাও চালের মতো তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে থাকে। একসময় এর শরীরের গন্ধ উৎপাদনকারী গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রস সুগন্ধি তৈরিতে ব্যবহূত হতো। বর্তমানে কৃত্রিম বিকল্প সুগন্ধি তৈরি হয়।
স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষে গন্ধগ্রন্থির নিঃসরণের মাধ্যমে নিজেদের সীমানা নির্ধারণ করে। মূলত একাকী হলেও প্রজননের সময় স্ত্রী-পুরুষ একত্রে থাকে। বছরে সাধারণত দুবার প্রজনন করে। গর্ভধারণকাল দুই মাসের কিছু বেশি। পুরোনো গাছের খোঁড়ল ছানা প্রসবের উপযুক্ত স্থান। কিন্তু খোঁড়লের অভাবে গাছের ডালার ফাঁকে, পরিত্যক্ত ঘর বা ইটের ভাটা, ধানের গোলা, তাল-সুপারির আগায় ছানা তোলে। প্রতিবার ছানা হয় তিনটি। ছানারা চোখ খোলে ১০-১২ দিনে। মা-গন্ধগোকুল দেহের সঙ্গে লেজ মিলিয়ে একটি বৃত্তের সৃষ্টি করে। ছানারা কখনোই বৃত্তের বাইরে যায় না। প্রায় ছয় মাস বয়সে ছানারা সাবালক হয়।
এশিয়ান গন্ধগোকুল ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, ভুটান, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয় উপত্যকা, সাবাহ, সারাওয়াক, ব্রুনেই দারুসসালাম, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, চীন, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা, জাভা, কালিম্যানতান, বইয়ান ও সিবেরাত এলাকায় স্থানীয়। ইরিয়ান জয়া, লেজার সুন্দ্রা দ্বীপপুঞ্জ, মালুকু, সুলাওজি এবং জাপানে এ প্রাণীর প্রাচীন আবাসস্থল। পাপুয়া নিউগিনিতে এদের উপস্থিতি তেমন চোখে পড়ে না।
তবে আপনি জানলে অবাক হবেন যে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি কফির প্রক্রিয়াকরণ হয়ে থাকে এই প্রাণীর পেটের ভেতর। সবচেয়ে দামি কফির নাম ‘কোপি লুয়াক’ বা ‘সিভেট কফি’। ইন্ডিয়ান পাম সিভেট এদেশে পরিচিত ভাম বা গন্ধগোকুল নামে। এই প্রাণীর মল থেকে কফির বীজ সংগ্রহ করে, সেই বীজ প্রক্রিয়াকরণের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয় এই কফি। তবে বর্তমানে ভারতে উৎপাদিত হলেও এভাবে কফি তৈরির পদ্ধতিটির সূচনা কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়ায়।
ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে এশিয়ান পাম সিভেট প্রজাতির প্রাণীর মল থেকেই প্রথম তৈরি হয় কোপি লুয়াক নামের এই কফি। এই প্রাণী নিয়মিত কফিফল খেয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রাণীর ঘ্রাণশক্তি অতি প্রবল, ফলে এরা বেছে বেছে সেরা ও পাকা কফিফলগুলি খায়। এদের পাচনতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় ফলের বাইরের অংশ পাচিত হয়ে গেলেও, পাচিত হয় না কফির বীজ। এদের মল সংগ্রহ করে তা প্রসেস করেই তৈরি করা হয়ে থাকে কোপি লুয়াক। সিভেটের শরীরের উৎসেচকই নাকি এই কফি বিনের স্বাদ ও গন্ধের প্রধান কারণ।
0 মন্তব্যসমূহ