শ্রীকান্ত নাথ,
কৃষিবিদ, রাজ্য কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, অরুন্ধতীনগর।
( তিনি পেশায় কৃষিবিদ হলেও সাহিত্য অঙ্গনে অবাধ বিচরণ তার। গান নাটকসহ লেখালেখিতে সুনাম রয়েছে )
দিনটা ছিল ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকের ঝলমলে এক সকাল। প্রতিদিনের মতো পূণ্যবালা চাকমা খাবার ব্যবস্থা করতে ভোর বেলাই বাড়ির পিছনের জঙ্গল থেকে সবজী, ওল ইত্যাদি সংগ্রহে ব্যস্ত। এমন সময় পাড়ার ছেলে উদোঙ্গমনি চাকমা এসে পূণ্যবালা আর তার জামাই বিহিরলাল কে হাকডাক শুরু করলো।
বছর পাঁচ পঞ্চাশের পূণ্যবালা শক্ত হাতে পরিবারের রাশ না ধরলে পুরো পরিবার কবেই যে দেও নদীর জলে তলিয়ে যেত। দুই ছেলে বিয়ে করে সংসার আলাদা করেছে কিন্তু রোজগারের অভাবে দুই ঘরেরই নাতি নাতনি বেশিরভাগ সময় পূণ্যবালার ঘরেই খাওয়া দাওয়া, আদর আবদার, অসুখ বিসুখে চলে আসে। বুড়োর বয়স ৬০ পার হয়েছে বছর দুই হলো, বারে বারে পঞ্চায়েত অফিস থেকে আশ্বাস দিলেও বয়স্ক ভাতা এখনো কপালে জোটে নি। যৌবনে স্বামী স্ত্রী মিলে অনেক দূরের দূরের জুমে মাসের পর মাস কাজ করেছে, তখন গায়েই লাগতো না,কিন্তু এই বয়সে শরীরে আর আগের জোর নেই, মাঝে মাঝে শ্বাসের টান উঠে। ছোট ছেলে বলছিল হাতে কিছু টাকা আসলে আগরতলা বড়ো হাসপাতালে গিয়ে মায়ের চিকিৎসা করাবে, পূণ্য রাজি হয় না, সেই ছোটবেলা থেকেই তারা অসুখ হলেই দুই গ্রাম পরে ধনিছড়ার শান্তি কবিরাজের ঔষধে সুস্থ হয়, এখনকার ছেলে ছোকরারা কিছু হলেই ডাক্তার খোঁজে। তাছাড়া ঘরের চালের কাজ করাতে হবে, গেলো বর্ষায় কষ্টে কাটিয়েছে, এইবার না করলেই নয়। বুড়োর একটা মাত্র ধুতি, সমাজে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতে হলে দুইদিন আগে ধুয়ে, ভালো করে ভাঁজ করে বালিশের নিচে চাপা দিয়ে রাখে। আরেকটা ধুতি হলে বুড়ো খুশীই হবে, কিন্তু হাতে কিছু টাকা দরকার।
"পূণ্য মাসী, তোমার বুড়ো কই? আজকে বাজারের হলে একটা দরকারি সভা আছে, তোমরা দুইজন আইতে লাগবো। ১১ টার দিকে খাইয়া দাইয়া আইলেই হইবো"
সব্জী থেকে ঘাস বাছতে বাছতে পূণ্য বলে উঠে
"তোমরা খালি সভা সমিতিই করবা, ইলেকশন আইছে মনে হয়!! আমার ঘুম থাকি উঠলে পেটের চিন্তা, সভা সমিতিতে ভাত ঝুটবো নি? বুড়া রে লইয়া যাও, রাস্তায় দুকানে বইয়া দাবা ( হুক্কা) টানে দেখো গিয়া।"
"না গো মাসী, ইলেকশনের মিটিং নায়, এগ্রিকালচার থাকি কিতা বুলে একটা স্কিম আইছে নতুন, পাড়ার হকলরে খবর দিতে কৈসে, গিয়া দেখোই না, লস তো নাই, আমি পাইলে বুড়া রে কইমু নে, আইচ্ছা আমি যাই।"
পূণ্য নিজের কাজ করতে করতে ভাবে, নিজের জমি আছে মাত্র আধা কানি, ভাগা হিসাবে আরো ৩-৩.৫ কানি জমি পাইলে এই বয়সে ও আরেকটু পরিশ্রম করে দেখতে পারতো। কিন্তু ভাগা পাওয়াও মুস্কিল, জমি খালি পড়ে থাকে কিন্তু বাবু মানুষরা ভাগা দেয় না। যাইহোক দেখি খাওয়া দাওয়া শেষ করে সময় পাই কিনা, বাজার তো পাশেই।
ত্রিপুরার শৈব তীর্থ উনকোটি জেলার পেঁচারথলের বাজারের পাশেই পূণ্যদের গ্রাম, নাম আন্ধারছড়া। গ্রামের পাশেই দেও নদীর এক ছোট ছড়া বয়ে গেছে, সেই ছড়ার নামের গ্রামের নাম। এক কালে ঘন জঙ্গলে দিনের বেলায়ও আলো ঢুকতো না গ্রামে, সেই থেকে আঁধার বা অন্ধকার থেকে আন্ধারছড়া নাম। এখন কিন্তু মূল বাজারের পাশে হওয়ায় আর আসাম আগরতলা মূল রাস্তার পাশে হওয়ায় গ্রামে অনেক পাকা বিল্ডিং, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ আর ডিশ অ্যান্টেনা। কিন্তু গরীব পূণ্যবালার ঘরের অন্ধকার আগেরই মতো।
বেলা ১১ টা বেজে আরো ১৫ মিনিট পরে পান চিবুতে চিবুতে হলে ঢুকলো পূণ্য। বাজারের পাশেই হলঘর, আগেই এই হল ছিলো টাউনহল, কতো যাত্রাপালা, পুতুলনাচ দেখলো, এখন বাজারের উত্তরে দুইতলা উঁচু বিশাল বিল্ডিং ঘর নাকি টাউনহল! এতো বড়ো বিল্ডিং, কিন্তু প্রায় সময়ই তালা বন্ধ, ইস এমন সুন্দর একটা ঘর যদি থাকতো, এইসব হাবিজাবি চিন্তা করতে করতে পানের পিক্ ফেলে ধীর পায়ে হলে ঢুকে পূণ্য। তার বুড়ো একটু বয়স্ক হওয়ায়, সামনের দিকে মুরুব্বীর চেয়ারে বসা, পরনে সেই ময়লা ঘোলাটে রংয়ের ধুতি, গায়ে ফতুয়া। পাড়ার সবাইকে খবর দিলেও হাতে গোনা ১০-১৫ জন লোকই উপস্থিত।
চেয়ারে বসে এগ্রিকালচার দপ্তরের ভিএলডাব্লিউ স্যার আর অল্প বয়সী সেক্টর স্যার একটানা মোবাইলে কি যেন দেখছে আর একটু পরে পরে আঙ্গুল নাড়াচ্ছে। পূণ্য কোনোদিন মোবাইল চালাতে অভ্যস্ত না, বুড়োর একটা ছোট ফোন আছে, মাঝে মধ্যে মাছমারা, কাঞ্চনপুর থেকে আত্মীয়রা ফোন করে, কিন্তু সেই ফোনে কথা বলতে পুণ্যর বড়ো সংকোচ। প্রথম প্রথম ফোন আসলে পূণ্য শাড়ি ঠিক করে, চুলটা গুছিয়ে, মুখে ঘাম মুছে কথা বলতে আসতো, ঘরের সবাই হাসতো, পূণ্য ভাবতো এতো দূর থেকে ফোন করেছে, একটু ঠিক মতো কাপড়চোপড় পরে না কথা বললে মানুষ যদি খারাপ পায়, পরে বুঝলো ফোন কথা শোনা যায়, দেখা যায় না।
যাইহোক, একটু পরেই তিন চার জন বাবু গাড়ি করে উপস্থিত হলেন হল ঘরে, তাদের দেখে সেক্টর আর ভিএলডাব্লিউ স্যার উঠে দাড়ালেন, জায়গা করে দিলেন মাঝখানের চেয়ারে, এনারা বোধ হয় আগরতলা থেকে এসেছেন, সেক্টর স্যারের ও বড়ো কোনো অফিসার।
বিহিরলালকে যখন সভাপতি হতে সবাই বললো, পূণ্য শাড়ির আঁচলে হাসি ঢাকে। ঘরের মরদকে এতো বড়ো বড়ো অফিসারদের সাথে এক আসনে বসতে দেখে ভালই লাগছে, ইসস যদি একটা ছবি তোলে রাখা যেতো।
আলোচনার শুরুতে অফিসার রা যা বললেন, নতুন এক ধরনের মক্কা বা ভুট্টা চাষ করার জন্য তারা সুদূর আগরতলা থেকে এসেছেন। কিন্তু সারা জীবনই তো জুমের ক্ষেতে পূণ্য মক্কা লাগায়, এর মাঝে নতুন জিনিস কি! কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝতে পারলো এই মক্কা আর সেই মক্কা এক নয়। অল্প বয়সে মক্কাতে ফুল আসলেই এই মক্কাকে শিশু অবস্থায় পেড়ে নিতে হবে, এর জন্য তার নাম বেবিকর্ন বা কচি ভুট্টা। পূণ্য কিছুতেই বুঝতে পারে না এই কচি মক্কা চাষ করে কীভাবে লাভজনক কৃষি সম্ভব। কিন্তু আস্তে আস্তে আলোচনায় উঠে আসে যে কিভাবে এই কচি ভুট্টা বাজারে খুব বেশি দামে বিক্রি হয়, এমন কি দেশে বিদেশে রপ্তানি হয়। আগরতলার বিদেশি চিনা রেস্টুরেন্টে এই সবজির দাম নাকি অনেক। পূণ্য অতশত বুঝে না, পরিশ্রম করে একটা ফসল করবে, বাজারে দাম পেলেই চলবে। সভায় গুঞ্জন শুরু হলো, এই ফসল এতো অল্পদিনে কাটলে লাভের মুখকি আদৌ দেখা যাবে? বীজ নাকি সরকারি ভাবে দেবে। কিছু টাকা পয়সাও পাওয়া যাবে। যাইহোক ঘণ্টা দুয়েকের আলোচনা সভার শেষদিকে চা আর মিষ্টির প্যাকেট হাতে নাম লিস্ট করার সময় দেখা গেলো অর্ধেক লোকেরাই ফসল করবে না। সভাপতির আসনে বসা বিহীরলাল অনিচ্ছা থাকলেও নিজের নামের পাশে লেখলো আধা কানি জায়গা। একে একে নাম আস্তে থাকলো উত্তম চাকমা, শান্তিরঞ্জন চাকমা, বিশ্বজিত চাকমা, চাত্রই চাকমা, রুপম চাকমা। কিন্তু এই ৫-৬ জনের পরে আর কেউ এগিয়ে আসলো না। আগরতলার অফিসার বললেন অল্প জায়গায় এই ফসল চাষ করলে লাভ তেমন একটা হবে না, দরকার একটু বেশি জায়গা। কিন্তু জমি থাকলেও অনেক বড়ো কৃষক অবজ্ঞা, অবিশ্বাসে নতুন ফসল করতে চাইলেন না। যাইহোক চা মিষ্টির শেষে সভা যখন শেষ হলো, আগামী কয়েকদিনের মাঝে স্টোর থেকে সার আর বীজ নেওয়ার কথা জানানো হলো, অবশ্য এর আগে জমিতে চাষ দিতে হবে।
অতিরিক্ত মিষ্টির ২ টা প্যাকেট আর নিজেরটা শাড়িতে গুঁজে ঘরের দিকে রওয়ানা দিলেন পূণ্য। ঘরে গেলেই নাতি নাতনিদের হাতে দিবে। মনে একটা খটকা রইলো, কি এই নতুন চাষ, কচি ভুট্টা করে আসলেই কি কিছু লাভের মুখ দেখবে? না আবার সব পন্ডশ্রম যাবে।
বিহিরলাল ঘরে গম্ভীর ভাবে ঢুকে দাবায় টান দে, পূণ্য তামসা করে
"সভাপতি মহাশয়ের কপালে এতো চিন্তা কিয়ের? মক্কা চাষের আগেই এই অবস্থা, আধা কানি জায়গা চাষ করে কি লাখপতি হইবা?”
" জানস নি প্রসন্নর মা ( প্রসন্ন পূণ্যদের বড়ো ছেলে) যদি কিছু আরো জমি ভাগাতে পাইতাম, তে একবার চেষ্টা করি দেখলাম নে। কিন্তু..."
"আরে সবিতার বাপ তো কইলো তাইন ইতা চাষ করতো নায়, তে তার জমিখান ভাগা দিলেই তো পারে।"
"আরে সবিতার বাপ হইলো ধনী মানুষ, তার চাষ করলেই কিতা না করলেই কিতা, তারার তো ভাত কাপড়ের টান নাই। দেখি বিকালে মাত কথা মাতিয়া।"
দাবার ধুঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বুড়ো বুড়ির কথার মাঝেই তাদের নাতি নাতনী এসে হাজির, পূণ্য গেলো সাপ্লাই এর জল আনতে।
সন্ধায় ঘরে ঢুকেই হাসি মুখে বিহিরলাল খবর দিলো সবিতার বাপ তার ৩ কানি জমি মক্কা চাষের জন্য দিয়া দিছে ভাগা হিসাবে। নতুন ফসল, লাভ লোকসান অনুমান করা যাচ্ছে না, তবুও ৩ কানি তে ৩ হাজার টাকা চাইছে, ফসল বিক্রি করে দিলেই চলবে। পূণ্য কিছু বলে না, শুধু ঈশ্বর বুদ্ধকে আনমনে প্রণাম করে, ভগবান যেনো এইবার একটু সহায় হয়।
যথা সময়ে ক্ষেতে মেশিন দিয়ে দুই চাষ দিয়ে জমি তৈরি করলো পূণ্য আর বিহিরলাল। বয়স পঞ্চাশ পার হলেও ক্ষেতের মাটিতে পা পড়লেই মনে হয় এইবার ইসপার কি উসপার করে ছাড়বে। কোদাল চালায় জমির কোনায় আর ভাবে যদি ফলন ভালো হয় তবে...। অফিস থেকে কথা মতো বীজ আর সার আসলো, জমি তৈরি। কিন্তু এর মাঝেই অসময়ে বৃষ্টি... সব পরিশ্রম মাটিতে। এইবারও মনে হয় পরিশ্রম সব জলে গেলো। সামনে পূজা, পূণ্যবালা নাতি নাতনী দের করুন চোখের দিকে চায় আর ভাবে পূজায় ঠাকুর দেখতে একেবারে খালি হাতে কিভাবে যাবে?
কালি পূজার পর আবার এগ্রিকালচার থেকে আবার স্যারেরা এলেন, আবার সবাইকে নিয়ে বসলেন, সরকার এতো বড়ো একটা প্রকল্প ত্রিপুরায় প্রথম বারের মতো এই অজো পাড়াগায়ে দিয়েছে, যদি আমরা সফল হই, তাহলে রাজ্যের সবাই আমাদের গল্প শুনবে, আর যদি ঘরে বসে দুঃখ করি, তাহলে কেউই আর সাহায্য করতে আসবে না।
"কথা তো সত্যি স্যার কিন্তু একবার ধার দেনা করে ক্ষেতে চাষ দিছি, এখন বৃষ্টিতে সব শেষ। আবার চাষ দিলে ডাবল খরচ।"
পূণ্যবালার কথায় সহমত পোষণ করে সেক্টর স্যার বললেন,
"আপনার কথা ঠিকই কিন্তু আমি কথা দিতাছি, এই ফসল করলে আপনাদের লোকসান হবে না। কানি প্রতি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা আপনারা হাতে পাবেন। আর ফসল আপনাদের মাঠ থেকে এসে কোম্পানির লোক কিনে নিয়ে যাবে। এমন কি মক্কার গাছও তারা কিনে কেটে নিয়ে যাবে।"
এমন অদ্ভুত কথা শুনে সবাই একটু চুপ হয়ে যায়। কৃষকের ক্ষেতের ফসল কোম্পানির লোক এসে কোনোদিন তো কিনে নেয় নি!! আর ফসলের কথা বাদ দিলাম, মক্কার গাছ আবার বিক্রি হয়? তাও জমিতে এসে কেটে টাকা দিয়ে নিয়ে যাবে? সেক্টর সাহেব কম বয়সের, তাই বোধ হয় ভুল হচ্ছে।
"স্যার আফনে ঠিক কথা কইরা নি? গাছ কিনতে তো হুনছি না কোনোদিন। লাকড়ি কাঠ হইলে আলাদা কথা, কিন্তু মক্কার গাছ কে কিনবো?”
পূণ্যর কথার উত্তরে সেক্টর বাবু হেসে উঠলেন
" আরে রাজ্য কৃষি দপ্তর মহারাষ্ট্রের এক কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করেছে, তাদের একটা আনারস প্রসেসিং এর কারখানা আছে কুমারঘাটের ইন্ডাস্ট্রি এলাকায়। তারাই আপনাদের কচি মক্কা বা বেবিকর্ণ কিনে নেবে। তারপর সেটাকে টিনের জারে ঢুকিয়ে বাইরে বিক্রি করবে। তাদের সাথে কথা ঠিক হয়েছে মক্কা নেওয়ার পরে গাছটাও তারা ওজন করে কিনে নেবে, সেই গাছ কেটে তৈরি হবে সবুজ পশুখাদ্য। তাহলে লাভটা দেখুন।"
"কিন্তু স্যার এই মক্কা ক্ষেত করিয়া আমরা পরের ফসল লাগাইতে পারমু নি? কতো দিনের হইবো এই নতুন মক্কা?”
"আরে না না, আপনারা ভুল বুঝতেছেন, দেখেন মক্কা ফসল মাস তিন লাগে ঠিকই কিন্তু যেহেতু এটা কচি মক্কা, তাই মাত্র 50-60 দিনেই আপনার ক্ষেত আবার খালি হবে পরবর্তী ফসলের জন্য। হিসাব করে দেখুন কতো সহজে আমন ধান আর সব্জী ক্ষেতের মাঝখানেও এই ফসল ৫০-৬০ দিনে বার করা যাবে। আর যদি কেউ পুরো বছর চাষ করতে চান, তাহলে চার পাঁচ বার ও এক জমিতে এই ফসল ফলাতে পারেন।"
পূণ্য যতো শুনে ততো অবাক হয়, আসলে কি এমন হবে? ভাগা জমি হাতে আসার পরে এখন প্রায় চার কানি জমি আছে.. যদি ২৫ হাজার না হোক, ২০ হাজার টাকাও হাতে আসে... চার কুড়িতে... আনমনে নামতা জপতে থাকে.. সে যাই হোক, আগে ফসল লাগাই তো।
আবার কথা মতো দীপাবলির পরে ক্ষেতে নামা হলো, আবার চাষ, আবার কোদাল, তবে এবার বৃষ্টি বাধা দিলো না। সেক্টর স্যার আর ভিএলডাব্লিউ বাবুরা প্রায়ই সকাল বিকাল গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বীজ শোধন, লাইনের দূরত্ব, সারের মাপ সব হাতে কলমে দেখিয়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার বেশি বুদ্ধি করে কিছুটা সার রেখে দিচ্ছেন সব্জী চাষে দেবে বলে। কিন্তু নতুন ফসল নিয়মমতো সার না দিলে ফলন ঠিক মতো আসবে না কথাটা স্যারেরা বার বার বোঝাচ্ছেন।
বীজ লাগানো হলো ঘটা করে, বীজ লাগানোর আগে মাঠের ঈশান কোণে পূজা হলো, ভগবানের উদ্দেশ্যে কয়েকটা বীজ আলাদা করে লাগিয়ে।
পূণ্য শুধু উপরের দিকে তাকিয়ে করজোড়ে ভক্তিভরে প্রণাম করে।
"এইবার তোমার ভরসা ঠাকুর...”
বিহিরলাল কথা কম বললেও ভিতরে টেনশন কাজ করে। জমি তো ভাগা নিয়েছি, যদি ফসল খারাপ হয়, কিভাবে কি করবে। ট্রাক্টরের পয়সাও প্রায় হাজার সাতেক বাকি। সামনে জলসেঁচে খরচ আছে।
প্রায় মাসখানেক পরে সেক্টর বাবুরা মাঠ দেখতে এলেন। বাকি চাষীদের মাঠে খারাপ ভালো গাছ থাকলেও পূণ্যবালার জমিতে আসলেই পরিশ্রম চোখে পড়ে। একটাও অতিরিক্ত ঘাস নাই, সমান উচ্চতায় সব গুলি গাছ, একেবারে লাইনে দাড়িয়ে। বোঝা যায় বুড়ো বুড়ী এই বয়সেও কাকভোর থেকে মাঠে রোজ পরিশ্রম করে। ভিএলডাব্লিউ বাবু হেসে বলে
"পূণ্য মাসী তোমার ক্ষেত একেবারে ফার্স্টপ্রাইজ.. খুব সুন্দর ক্ষেত করছো গো মাসী.. ফলন ভালো হইবো।"
"ইতা ঠিক আছে, কাম কাজ তো পূজার পরে তেমন কিছু নাই, এর লাগি আমরা বুড়া বুড়ি রোজ সকালে আইয়া পড়ি ক্ষেতে... সামনের দিনে আর কিতা কিতা করা লাগবো ওখান খালি কইয়া যাইবা..."
বিহিরলালের কথায় হেসে সেক্টর বাবু বললেন
"আগামী ১০-১৫ দিন পরে গাছের মাথায় ফুল ফুটলে, দেখা মাত্র ফুলটা ভাঙ্গি দিবা। এই রকম চলবো সপ্তাহ খানেক.. গাছ যাতে নষ্ট না হয় ফুল ভাঙার সময়।"
পূণ্য স্যারের কথা শেষ হতে না হতে অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে,"আফনে হয়তো ঠিক কইরা কিন্তু গাছের ফুল ভাঙ্গি দিলে ফল হইবো কেমনে স্যার? ইতা তো কুনোদিন হুনছি না।"
"আরে না না এমন না, আসলে মক্কা গেছে পুরুষ ফুল আগে আসে, এর পরে আসে স্ত্রী ফুল। কচি মক্কা বা বেবিকর্ণ ফলাতে গেলে পুরুষ ফুল ভেঙে দিতে হবে আর স্ত্রী ফুলে ফল আসে দিন দুয়েকের মাঝেই পেড়ে নিতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে পুরুষ আর স্ত্রী ফুলের মিলন যেনো না হয়। পরাগের মিলনে স্ত্রী ফুলে পূর্ন আকারে বড়ো ভুট্টা বা মক্কা হয়ে যাবে, আমাদের লক্ষ্য কচি মক্কা।"
কিছুটা বুঝে কিছুটা না বোঝে পূণ্য মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। প্রায় ৪০-৪৫ দিনের মাথায় একদিন সকালে মক্কা জমিতে দেখা দিলো সেই পুরুষ ফুল, দেখা মাত্র পূণ্য আর বিহিরলাল যত্নকরে ভাঙতে লাগলো ফুল গুলি।
এইবার অপেক্ষা... ফসল ঘরে তোলার। হিসাবমতে ৫০-৫৫ দিনেই প্রথম ফলন আসার কথা। কুমারঘাটের কোম্পানি থেকে লোক এসে এর মাঝে মাঠ দেখে গেছেন। কবে কি ভাবে ফসল পাড়তে হবে বার বার বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন।
ঠিক ৫২ দিনের মাথায় সকাল বেলা পূণ্য দেখলো হাতের আঙ্গুলের মতো ছোট ছোট ভুট্টা উকি দিচ্ছে গাছের মাঝ বরাবর। গাছ থেকে ফল পাড়বে কি না ঠাহর করতে পারছে না, ক্ষেতের আরেক দিকে বুড়োকে ডাক দিলো, এরপরে দুইজন মিলে প্রথম ফসল তুললো.. একেবারে শিশুই.. ছোট ছোট দেখতে কি সুন্দর। খোসা ছাড়ানোর পরে একেবারে সোনালী রঙের আঙ্গুলের সাইজের। কোম্পানির লোক আর সেক্টর স্যার তারা বলে গেছেন ৮-১০ সেন্টিমিটার বড়ো হলেই পেড়ে নিতে হবে মক্কা, এর থেকে বড়ো করা চলবে না। তারপর একেএকে লাইনের পর লাইন গাছ পরীক্ষা করে দেখলো প্রায় সব গাছেই ফল ধরেছে। পূণ্যবালার চোখের কোণে আনন্দের অশ্রু। পরিশ্রম সার্থক। পরের দিন থেকে শুরু হলো কচি ভুট্টা পাড়া। প্রথম দিনেই ২৫-৩০ বস্তা মক্কা পাড়া হলো। কোম্পানির লোক এসে ওজন করে খোসা না ছাড়িয়েই ভুট্টা বস্তায় ঢুকায়, হিসাবের খাতায় লেখা হচ্ছে কবে কতো কেজি ভুট্টা নেওয় হচ্ছে। পূণ্যবালা এই কদিন খুব ব্যস্ত। সকাল সকাল উঠে ফসল পাড়তে শুরু করে বেলা বাড়ার সাথে সাথে রোদের সাথে বেশিক্ষণ টিকা যায় না। এক একটা গাছে ২-৩ টা করে ফল আসছে। প্রথম ফলের দুই দিনের মাথায় দ্বিতীয় ফল চলে আসে, প্রায় লাখ খানেক গাছ কানি প্রতি, পূণ্য আর বিহিরলালের সাথে হাত লাগায় তাদের দুই ছেলে আর ছেলের বৌ। চার কানি জায়গায় চার লাখ গাছের ফলন নেওয়া সহজ ব্যাপার নয়। নিজের সন্তানের মতো যত্ন করে গাছ বড়ো করেছে পূণ্য এখন সুদে আসলে ভালো ফলন দিয়ে প্রতিদান দিচ্ছে গাছ। আগরতলা থেকে স্যারেরা দেখতে আসেন পূণ্যর ক্ষেত। বেশিরভাগ সময় ফলন কম হয় বলে কৃষকরা আক্ষেপ করে, এইবার উল্টো। বেশি ফলন পাড়তে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে কৃষকরা। এইদিকে আবার গেছে ভুট্টা একদিন বেশী থাকলেই বাজারে দাম কমে যাবে। যাইহোক সকলেই খুশি।
ফেব্রয়ারি মাসের মাঝ বরাবর, রাজ্যে নির্বাচনের পালা প্রায় শেষ। পেঁচারথলের আন্ধারছড়ার মাঠে আজকে কৃষি দপ্তর থেকে এক মাঠ দিবসের আয়োজন করা হয়েছে। যারা যারা বেবিকর্ন চাষে ভালো সফলতা পেয়েছেন তাদের কে একে একে মাইকে কিছু বলতে ডাকা হলো।
নতুন সাদা ধুতি পরে আজকে স্টেজে আবার বিহিরলাল। হিসাব করে জানালো যে চার কানি ক্ষেত করে হাতে এসেছে প্রায় এক লাখ টাকা। জমির ভাগার টাকা, হালের খরচ, জলের মেশিনের ভাড়া সব বাদ দিয়ে ও ৭৫ হাজারের উপরে টাকা এইবার লাভ হলো।আগামীতে যেনো এই লাভজনক ফসল সকল কৃষক একসাথে করতে পারে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো মক্কা নেওয়ার পরে শুধু গাছ বিক্রি করে কানি প্রতি ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা হাতে এসেছে, বাকি ১৮ থেকে ১৯ হাজার টাকা কানি প্রতি পেয়েছে কচি ভুট্টা থেকে। সর্বমোট প্রায় ২৫ হাজার টাকা এক কানিতে।
এলাকার প্রায় ১০ জন কৃষকের মাঝে সবচেয়ে ভালো ফসল ফলানোতে পূণ্যবালার হাতে কৃষি দপ্তর থেকে তোলে দেওয়া হয় একটা জলের মেশিন। লজ্জা শরমের ঘোমটা দিয়ে সভাপতি বিহিরলালের হাত থেকে মেশিন নিতে স্টেজে উঠে পূণ্য। আজকে পূণ্যর পরনেও নতুন শাড়ী, ছোট ছেলে নতুন কিনা মোবাইল ফোনে এই সুন্দর মুহূর্তটা ছবি তোলে রাখে।
এরপর সবাই মিলে গাড়ি করে গেলেন কুমারঘাটে ইন্ডাস্ট্রি এলাকায়। কিভাবে তাদের ফসলকে টিউনের জারে ঢোকানো হচ্ছে দেখতে। কোম্পানির লোকেরা দেখলেন কিভাবে ফসলের খোসা ছাড়িয়ে যত্ন করে টিনের ডাব্বাতে ঢোকানো হচ্ছে সেই কচি ভুট্টা। এর পর সারি সারি টিনের ডাব্বা দেখে পূণ্য অবাক হয়ে যায়। পেঁচারথলের বাজারে তো এতো লোক নেই, তাহলে কোম্পানি কোথায় বিক্রি করবে এতগুলি মক্কা। পরে শুনলো এইগুলি নাকি ত্রিপুরা থেকে যাবে বোম্বাই শহরে, সেখান থেকে জাহাজে করে পাড়ি দিবে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে আমেরিকা ইউরোপের বিভিন্ন শহরে। সেইদেশে এই ফসলের অনেক দাম। কোম্পানির সামনের বৈঠক ঘরে একটা বড়ো মানচিত্রে বিহিরলালকে আরেকজন আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে ত্রিপুরা কোথায়, বোম্বাই কোথায় আর আমেরিকা কোথায় হতে পারে। বিহিরলাল ও বুঝে না বুঝে মাথা নাড়াচ্ছে। পূণ্য শুধু দুর থেকে বসে হিসাব করে, ছোট ছেলের মোবাইল, ঘরের চালে নতুন টিন, পরিবারের বড়ো ছোট সবার জন্য নতুন কাপড়ের পরেও হাতে হাজার দশেক টাকা রয়ে গেছে। জীবনে এই প্রথম হাতে টাকা সঞ্চয় করেছে পূণ্য। কি কি করবে খালি সকালে একবার হিসাব করে বিকালে আরেকবার। আগামী পূর্ণিমাতে বৌদ্ধমন্দিরে একটা পূজা দিতে হবে, আগের মানত করা। আর মনে মনে খুশি হয় আন্ধারছড়ার মক্কা খাবে আমেরিকার সাহেব মেমরা। তারা কি জানবে এই পূণ্যবালার পরিশ্রমের কথা। গ্রামের সবাই পাড়ার দোকানে জটলা করে কিভাবে আগামী সিজনে প্রায় সবাই এই ফসল করবে। মুরুব্বী হিসাবে বিহিরলাল থেকে সবাই বুদ্ধি নেয়। পূণ্য ঘরে বসে বসে শুনে সেই সব আগামীর প্ল্যানিং। ঘরে একটা ফ্যান লাগাতে হবে, এইবারের গরম পড়বে।
0 মন্তব্যসমূহ