আগরতলা, ২৯ মে : নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত নীতি আয়োগের বৈঠকে রাজ্যের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ৮টি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে তুলে ধরেন মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর ডা মানিক সাহা। দিল্লি সফরকালে মুখ্যমন্ত্রী নীতি আয়োগের বৈঠকে অংশ নেওয়া ছাড়াও নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং মুখ্যমন্ত্রীদের কনক্লেভে অংশ নেন। আজ নয়াদিল্লি থেকে রাজ্যে ফিরে এসে সচিবালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রীর দিল্লি সফরের বিভিন্ন বিষয়সমূহ তুলে ধরেন। সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর ডা মানিক সাহা জানান, গতকাল তিনি নয়াদিল্লিতে নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেন। নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন দেশের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। মুখ্যমন্ত্রী জানান, এই ভবন নির্মাণে রাজস্থানের পাথর, মহারাষ্ট্রের কাঠ, উত্তর প্রদেশের কার্পেট এবং ত্রিপুরার বাঁশের টাইলস ব্যবহৃত হয়েছে। ত্রিপুরাবাসী হিসাবে নিঃসন্দেহে এটি গর্বের বিষয় বলে মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে উল্লেখ করেছেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর ডা মানিক সাহা বলেন, নীতি আয়োগের বৈঠকে ৮টি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। বিকশিত ভারত-২০৪৭ কে সামনে রেখে রাজ্য সরকার ২০৪৭ পর্যন্ত রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নের রূপরেখা নির্দিষ্ট করেছে। সরকার ২০২২ সালের ২১ জানুয়ারি পূর্ণরাজ্য দিবস উপলক্ষে ‘লক্ষ্য-২০৪৭' শীর্ষক এই ভিশন ডকুমেন্ট প্রকাশ করেছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, রাজ্যে শিল্পের বিকাশে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, রাবার, চা, বাঁশ ভিত্তিক শিল্প, হস্তশিল্প, কৃষি ও উদ্যান ফসলভিত্তিক অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কারণ এমএসএমই ক্ষেত্রের উন্নয়ন বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ সহায়তা করছে। ‘ত্রিপুরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন ইনসেনটিভ স্কিম (টিআইআইপিআইএস) ২০২২'-এর অধীনে এমএসএমই গুলির জন্য মূলধনী ভর্তুকী, কম খরচে বিদ্যুৎ ইত্যাদি সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে। ত্রিপুরাকে দেশের মধ্যে আগর বাণিজ্যের হাব হিসেবে গড়ে তুলতে এবং ২০২৫-র মধ্যে ২০০০ কোটি টাকা মূল্যের আগর অর্থনীতির সুযোগ নিতে রাজ্য সরকার ‘ত্রিপুরা আগর উড পলিসি-২০২১' প্রকাশ করেছে। তিনি বলেন, রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে উৎপাদন নির্ভর শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগ টানতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সেই উদ্দেশ্যেই ‘স্বাগত' পোর্টালের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিনিয়োগের প্রস্তাবগুলিকে ‘সিঙ্গল উইন্ডো সিস্টেমে অনুমোদন দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে। এই পোর্টালে ১৭টি দপ্তরের ৬০টি পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে যাতে ব্যবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন অনুমোদন তাড়াতাড়ি দেওয়া সম্ভব হয়।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, রাজ্য সরকার তার মূলধনী ব্যয় ২০২০-২১ এর ৮৩৫.০০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০২২-২৩ বছরে ২২০০ কোটি টাকা করেছে।
তিনি জানান, আসন্ন নর্থ-ইস্ট গ্লোব্যাল ইনভেস্টস সামিট ২০২৩ এর প্রাক্কালে রাজ্য সরকার ডোনার মন্ত্রকের সাথে মিলে রাজ্যে বিনিয়োগের সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখতে একটি গোল টেবিল সম্মেলন করেছে। এই সম্মেলনের ফলে দেশী ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের সাথে ৩৩৮.০০ কোটি টাকা মূল্যের মৌ স্বাক্ষরিত হয়েছে। শিল্পোন্নয়নের জন্য ২ হাজার একর জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। তাছাড়া রাজ্যের ১৫টি শিল্প নগরীর উন্নয়নে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকও ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। বিমান যাত্রীদের সুবিধার্থে রাজ্য সরকার এভিয়েশন টার্বাইন ফিউল-এ ১ শতাংশ ভ্যাট কমিয়ে আনার কথাও বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী তুলে ধরেন।তিনি জানান, বিমান পরিষেবাকে উৎসাহ দিতে রাজ্য সরকার বার্ষিক ১৪ কোটি টাকা ভর্তুকী দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী জানান, বিজনেস রিফর্মস অ্যাকশন প্ল্যান (বিআরএপি) ২০২০-র রিপোর্টে ত্রিপুরাকে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে প্রগতিশীল শ্রেণীতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। সরকারের ইজ অব ডুয়িং বিজনেস নীতিকে আইনী সমর্থন দেওয়ার লক্ষ্যে ‘ত্রিপুরা ইন্ডাস্ট্রিজ (ফ্যাসিলিটেশন অ্যাক্ট ২০১৮' প্রণয়ন করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “মহিলাদের ক্ষমতায়নের জন্য ত্রিপুরা রাজ্য পলিসি ২০২২' রাজ্য প্রণয়ন করেছে। রাজ্যে মহিলাদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সরকারি চাকুরিতে রাজ্যে মহিলাদের জন্য ৩৩ শতাংশ পদ সংরক্ষণ রাখা হয়েছে। ত্রিপুরা স্টেট রাইফেলসে শুধুমাত্র মহিলাদের নিয়ে একটি ব্যাটেলিয়ান গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও মহিলা পরিচালিত স্ব-সহায়ক গোষ্ঠির সংখ্যা বৃদ্ধি সহ তাদের বিভিন্ন কার্যকলাপগুলি বৈঠকে তুলে ধরেন বলে মুখ্যমন্ত্রী জানান।
সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, অনাথ, শিশু এবং মায়েদের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে, তাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে, নিরাপদ প্রসব সুনিশ্চিত করা, অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি কমিয়ে আনা ও রক্তাল্পতার হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে রাজ্য সরকার নিরন্তর কাজ করে চলেছে। এক্ষেত্রে তিনি শিশু এবং মায়েদের স্বাস্থ্যের জন্য রাজ্য সরকারের গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্পের কথাও বৈঠকে তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যক্ষ্মা মুক্ত দেশ গড়ার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ২০২৫ সালের মধ্যে ভারত যক্ষ্মা মুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে বলে মুখ্যমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, রাজ্য সরকার ব্যাপকভাবে ‘ভোক্যাল ফর লোক্যাল' নীতিকে আনুসরণ করে স্থানীয় দক্ষতা এবং পরম্পরার বিকাশ ও সংরক্ষণে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। আগামীতে রাজ্য সরকারের ত্রিপুরা মেডিক্যাল ট্যুারিজম পলিসি চালু করার বিষয়টিও বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী তুলে ধরেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী গতিশক্তি প্রকল্পে রাজ্যের অগ্রগতির কথা বৈঠকে তুলে ধরে জানান এই প্রকল্প ১০৯.১৯ কোটি টাকা মূল্যের ৮টি প্রকল্প চিহ্নিত করে অর্থ মঞ্জুরির জন্য ভারত সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব ইন্ডাস্ট্রি এন্ড ইন্টারনেল ট্রেডের (ডিপিআইআইটি) কাছে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ৪টি প্রকল্পের জন্য ৩৫ কোটি টাকা ভারত সরকারের অর্থ মন্ত্রকের অধীন ব্যয় দপ্তরের মঞ্জুরি পাওয়া গেছে। এছাড়াও তিনি দ্য ত্রিপুরা ইন্টিগ্রটেড লজিস্টিক পলিসি ২০২২ এর কথাও বৈঠকে উল্লেখ করেন। নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্বে আয়োজিত মুখ্যমন্ত্রীদের কনক্লেভেও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর ডাঃ মানিক সাহা অংশ নেন।
মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর ডা মানিক সাহা এই কনক্লেভে ফ্ল্যাগশীপ প্রোগ্রামের বিভিন্ন সাফল্য ও বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেন। সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী যে ১৩টি পয়েন্টের উপর কনক্লেভে আলোচনা হয়েছে তার মুখ্য বিষয়গুলি তুলে ধরেন। মুখ্যমন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় (আরবান) ৬ মাসের হিসাব অনুযায়ী রাজ্যের সাফল্য ৭৩ শতাংশ। মোট ৮২,২১৭টির বেশি ঘরের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, এর মধ্যে ৫৭ হাজার ৪০টি ঘর নির্মিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় (গ্রামীণ) রাজ্যের সাফল্যের হার ৯১.১৯ শতাংশ। এর জন্য ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা। মোট ১ লক্ষ ৭৯ হাজার ৯৮৯ জন সুবিধাভোগী উপকৃত হয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, রাজ্যের এই সাফল্যের জন্য প্রশংসাও মিলেছে। বিভিন্ন ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপাও জুটেছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, জল জীবন মিশনে রাজ্যের সাফল্যের হার ৬২.১৪ শতাংশ। আগামী ডিসেম্বর, ২০২৩-এর মধ্যে বাকী কাজ শেষ হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। আয়ুস্মান ভারত প্রকল্পে ৯৪.৬২ শতাংশ সফলতা অর্জন করেছে রাজ্য। পিএম গ্রাম সড়ক যোজনায় ৮৮ শতাংশ এবং পিএম জীবন জ্যোতি প্রকল্পে ৮১ শতাংশ সফলতা অর্জিত হয়েছে। কিষাণ সম্মান নিধি প্রকল্পে রাজ্যে ২ লক্ষ ৪৭ হাজার কৃষক উপকৃত হয়েছেন। এই ক্ষেত্রে সাফল্যের হার ৯৮ শতাংশ। কিষান ক্রেডিট কার্ড প্রদানে রাজ্যের সফলতার কথা মুখ্যমন্ত্রী কনক্লেভে তুলে ধরেন। অটল পেনশন যোজনায় ৭৩ শতাংশ সফলতা এসেছে। স্ব-নিধি যোজনার উপর প্রধানমন্ত্রী গুরুত্ব আরোপ করেছেন। স্ট্রিট ভেন্ডারদের আর্থ সামাজিক বিকাশের জন্য এই প্রকল্পে এখন পর্যন্ত রাজ্যের সাফল্যের হার ৭০ শতাংশ। জিএসটি সংগ্রহের উপর রাজ্য সরকার কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছে। বৈঠকে জিএসটি সংগ্রহের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানান। সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যসচিব জে কে সিনহা এবং সচিব ডঃ পি কে চক্রবর্তী উপস্থিত ছিলেন।
0 মন্তব্যসমূহ