আগরতলা, ২০ মে ২০২৩: পৃথিবীতে থাকা উপকারী পতঙ্গগুলির মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে মৌমাছি। সাধারণ মানুষ এই পতঙ্গটি সম্পর্কে যতটুকু জানেন তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এরা জীববৈচিত্রকে রক্ষা করার জন্য। মানুষের মধ্যে মৌমাছি সম্পর্কে আরো বেশি করে সচেতনতা গড়ে তুলতে কুড়ি মে দিনটিকে বিশ্ব মৌমাছি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই দিবসের তাৎপর্য এবং মৌমাছির সম্পর্কে মামা অজানা বিষয় জানান ত্রিপুরা সরকারের কৃষি এবং কৃষক কল্যাণ দপ্তরের কৃষিবিদ শ্রীকান্ত নাথ নাথ।
তিনি বলেন, মৌমাছি নামটা শুনলেই আমাদের মনে একটা মধুর মিষ্টতা আর মৌমাছির হুল ফোটানোর ভয়ের কথা একসাথে মনে পড়ে। কিন্তু আজকের দিনে মধু বলতেই শপিং মলের থাকে রাখা বিভিন্ন কোম্পানির ব্র্যান্ডেড মধুই আমরা জানি, কে কার থেকে বেশি খাঁটি টা নিয়ে চলে বিজ্ঞাপন। খাঁটি হোক বা না হোক, মৌমাছি পালন আমাদের কাছে একটা ভয়ানক ব্যাপার! কিন্তু জানেন কি মধু উৎপাদন নিয়ে মৌমাছিকে আমরা যতো কৃতিত্ব দেই, তার থেকে বেশি কাজ করছে তারা আমাদের খাদ্য শস্য এবং জৈব বৈচিত্র্য ধরে রাখতে। আমরা অনেকেই মানবসভ্যতার প্রতি মৌমাছির এই অবদানের কথা একেবারেই জানি না অথবা অল্প সল্প জানি। মৌমাছি পালনের প্রবর্তক আন্তন জানসা ১৭৩৪ সালের ২০ মে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মৌমাছি এবং পরাগ সংযোগকারী পতঙ্গদের পরিবেশ রক্ষায় অবদানের বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতে জাতিসংঘ ২০১৭ সালে প্রস্তাব গ্রহণ করে। ২০১৮ সাল থেকে ২০ মে প্রতিবছর বিশ্ব মৌমাছি দিবস হিসাবে পালন করে আসছে। ২০২৩ সালের থিম বা প্রতিপাদ্য - "পরাগ সংযোগী কৃষি উৎপাদনে আরো জড়িত হও" (Bee engaged in pollinator friendly agricultural production)।
পরাগ মিলনের জন্য মৌ-চাষ এখন আধুনিক প্রযুক্তি হিসেবে ব্যাবহৃত হয়। ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানোর সময় মৌমাছিরা তাদের পা এবং শরীরের লোম অসংখ্য পরাগরেণু বয়ে বেড়ায়। এর ফলে পরাগ সংযোগের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
পৃথিবীর প্রায় ১১৫ ধরনের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাদ্য শস্যের মাঝে প্রায় ৯০ প্রজাতির পরাগায়নের জন্য মৌমাছি অথবা অন্যান্য পরাগায়নকারি পতঙ্গের প্রয়োজন। কি নেই সেই তালিকায় যেমন আপেল, আলমন্ড,বিভিন্ন প্রজাতির বীন, বিট রুট, বাঁধাকপি, ফুলকপি, শশা,বেগুন,আদা, আঙ্গুর, লেটুস, সরিষা, পেঁয়াজ, মিষ্টিকুমড়, মুলা, স্কোয়াশ, সূর্যমুখী ফুল, মিষ্টি আলু, তরমুজ ইত্যাদি। পশ্চিমা দেশে শুধুমাত্র পরাগায়নের কাজে মৌমাছির বাক্স ভাড়া দেওয়া হয়। উত্তর আমেরিকায় প্রতিবছর ১৫ লক্ষ মৌমাছি বাক্স ভাড়ায় দেওয়া হয় এবং এই বাক্স দিয়ে যে পরিমাণ খাদ্য শস্য উৎপাদন হয় তা প্রায় বছরে ১৫০০ কোটি আমেরিকান ডলার দেশটার অর্থনীতিতে যুক্ত হয়। ভারতের ক্ষেত্রে মৌমাছি নির্ভর কৃষি জমির পরিমাণ প্রায় ৫০০ লাখ হেক্টর যার জন্য প্রয়োজন প্রায় ১৫০০ লাখ মৌমাছির কলোনি। অথচ আমাদের দেশে আজকের দিনে আছে সর্ব সাকুল্যে ১২ লাখ মৌমাছির কলোনি যা বাণিজ্যিক ভাবে পরাগায়নে ব্যাবহার হয়। এর থেকে সহজেই অনুমান করা যায় এই সেক্টরে কতো বেশি কাজের এবং রোজগারের সম্ভাবনা রয়ে গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে মৌমাছির দিয়ে কৃত্রিম পরাগায়ন করালে স্বাভাবিকের চেয়ে ফলনের মাত্রা বেড়ে যায় অনেকগুণ। যেমন সরিষার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ফলনের প্রায় ৪৩%, সূর্যমুখী ফুল ৩২-৪৮%, কার্পাস - ১৭-১৯%, পেঁয়াজ - ৯৩%, আপেল - ৪৪%, লুসার্ন - ১১২%, কার্ডামম বা এলাচ -২১-৩৭%। তাই বিদেশে কৃত্রিম পরাগায়নের জন্য মৌমাছির এতো চাহিদা। শুধুমাত্র পরাগায়নের জন্য প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থনৈতিক লাভ মৌমাছি এনে দেয় সেটা পুরো বিশ্বে প্রায় ২২৪ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার। আমেরিকার জন্য প্রায় ১৫-২০, নিউজিল্যান্ডে - ২২ এবং ভারতের ক্ষেত্রে হতে পারে প্রায় ৩০ (বিলিয়ন আমেরিকান ডলার)।
তাই শুধু মধু বা মধুর সাথে যে সব উপাদান আমরা মৌমাছি থেকে পাই, তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই ছোট একটা পতঙ্গ মানব সভ্যতার সঠিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়। কিন্তু আধুনিক কৃষির অগ্রগতিতে প্রচুর পরিমাণ কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে এই মহামূল্যবান পতঙ্গ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের পরিবেশ থেকে। মানব সভ্যতার এই নীরব পরোপকারী বন্ধুকে হারিয়ে ফেললে আমাদের অস্তিত্ব ভবিষ্যতে হয়ে বিপন্ন। তাই আলবার্ট আইনস্টাইন সতর্ক করেছিলেন "পৃথিবী থেকে যদি মৌমাছি একদিন হারিয়ে যায়, মানব সভ্যতা খুব বেশি হলে সেইদিন থেকে বছর চারেক টিকে থাকবে।" তাই আসুন বিশ্ব মৌমাছি দিবসে প্রত্যেকে আমরা এই বিশেষ পতঙ্গ থেকে ভয় না পেয়ে কিভাবে তার রক্ষা করা যায় এবং আমাদের জীবন জীবিকা নির্বাহে তার ব্যবহার করা যায়, সেই বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করি।
0 মন্তব্যসমূহ