ড: হৈমন্তী ভট্টাচার্যী
সভ্যতার অভিমুখে মানুষ যত এক পা এক পা করে এগিয়ে গেছে, ততই সে ক্ষতি করেছে প্রকৃতির। মানুষের তৈরি অনেক জিনিসই আজ মানব সভ্যতার সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে, প্রকৃতিকে ধ্বংসের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে;
তেমনি একটি জিনিস হল- প্লাস্টিক
প্লাস্টিক এখন আধুনিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। একসময় জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাপড়ের থলি, পাটের তৈরি ব্যাগ, কাগজের প্যাকেট ব্যবহার করা হতো। এগুলি ছিল পরিবেশ বান্ধব- ব্যবহার করার পর ফেলে দিলে সহজেই প্রকৃতিতে মিশে যেতো, পরিবেশের কোনো ক্ষতি করতো না। বর্তমানে আমরা জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্লাস্টিকের তৈরি ক্যারিব্যাগ ব্যবহার করি যা পরিবেশের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর।
শুধু ক্যারিব্যাগ নয়, প্লাস্টিকের তৈরি হাজার রকমের জিনিস আমরা ব্যবহার করে থাকি। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর যে টুথ ব্রাশ দিয়ে আমরা মুখ ধুই সেটিও প্লাস্টিকের তৈরি, জলের বোতল প্লাস্টিকের তৈরি, অনেকেই প্লাস্টিকের টিফিন ক্যারিয়ারে স্কুলে খাবার নিয়ে যায়; ঘরের অনেক জিনিসপত্র- কৌটো থেকে শুরু করে শোপিস সবই প্লাস্টিকের তৈরি। মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, হোম থিয়েটার, সাউন্ড সিস্টেম – এসবের কাভার/ কেবিনেট প্লাস্টিকের তৈরি। এমনকি আমরা যেসব কলম দিয়ে লেখি সেগুলিও বেশিরভাগ প্লাস্টিকের তৈরি। প্লাস্টিকের তৈরি জিনিসের দাম কম এবং টেকসই বেশি হয়। আমরাও তাই নির্বিচারে প্লাস্টিকের জিনিস ব্যবহার করি। আর এইজন্য আজ ঘরে বাইরে চারিদিকে প্লাস্টিকের স্তুপ।
প্লাস্টিক দূষণের নানা দিক
প্লাস্টিক দূষণের কারণে মাটির উর্বরতা ব্যাহত হয়, কৃষি উৎপাদনশীলতা বাধাগ্রস্ত হয় এবং বাস্তুতন্ত্রের সুস্থতা বিঘ্নিত হয়। প্লাস্টিক বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলার ফলে পরিবেশে বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ মিশে যায়, যার ফলে বায়ু দূষণ ঘটে এবং পরবর্তীতে শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত রোগব্যাধির মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
তাছাড়া
১.প্লাস্টিক পরিবেশের শত্রু। ব্যবহার করার পর প্লাস্টিকগুলি যেখানে ফেলা হয় সেখানকার মাটি দূষিত হয়ে যায়। বিশেষত যেসব প্লাস্টিক ৫ মাইক্রনের কম পুরু হয় সেগুলি দীর্ঘদিন একইরকম থেকে যায়। এরফলে সেই মাটিতে কোনো গাছ জন্মাতে পারে না।
২.বেশিরভাগ প্লাস্টিকের ব্যাগ মানুষ একবার ব্যবহার করে রাস্তায় ফেলে দেয়। কারণ, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে সেগুলিকে গৃহস্থের আবর্জনা বলে মনে করা হয়। এরপর রাস্তায় পড়ে থাকা প্লাস্টিক যদি গরু, ছাগল বা কুকুরের পেটে যায় তবে সেটি অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং একসময় মারা যায়।
৩.আবার, বৃষ্টির জলের মাধ্যমে এই সমস্ত প্লাস্টিক গিয়ে পড়ে নদীতে এবং সমুদ্রে। ফলে সেখানকার পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে। সমুদ্রের নীচে যে বৈচিত্রময় জীবজগত রয়েছে, মানুষের ব্যবহৃত প্লাস্টিক সেই জীবজগতেরও ক্ষতিসাধন করছে।
প্লাস্টিক দূষণ প্রতিকারের উপায়
প্লাস্টিক দূষণ এখন সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে দুশ্চিন্তার বিষয়। এখনই যদি কোন ব্যবস্থা নেওয়া না হয় তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের অনেক বড় বিপদের মধ্যে পড়তে হবে। নিম্নলিখিত উপায় অবলম্বন করে প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে।
১)পুনর্নবীকরণ: প্লাস্টিক রিসাইক্লিং বা ব্যবহার করা প্লাস্টিকগুলি যাতে আবার ব্যবহার করা যায় সেই ব্যবস্থা করলে প্লাস্টিক দূষণ অনেকটাই মোকাবিলা করা যাবে। ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ব্যবহার করে নানান নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করা যেতে পারে। এই কাজে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন সয়ম্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের স্বনিযুক্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আবার, সম্প্রতি রাস্তা তৈরির কাজে পিচের পরিবর্তে প্লাস্টিক ব্যবহার করার কথা ভাবা হচ্ছে। তেমনটা হলে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের একটা বড় অংশ পুনরায় ব্যবহার করা যাবে।
২) নিয়ন্ত্রণ: গবেষণায় দেখা গেছে যে, ৫ মাইক্রনের কম পুরু প্লাস্টিক পরিবেশের পক্ষে বেশি ক্ষতিকর। তাই অবিলম্বে সেগুলির উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাছাড়া, সামগ্রিকভাবে প্লাস্টিকের ব্যবহারও নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। প্রয়োজন হলে, আইন তৈরি করে প্লাস্টিক উৎপাদন এবং প্লাস্টিকজাত সামগ্রীর ব্যবহার কঠোরহাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৩) বিকল্প তৈরি: প্লাস্টিক বর্তমানে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। তাই হঠাৎ করে প্লাস্টিকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে অনেকেই সমস্যার সম্মুখীন হবেন। সুতরাং প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বা পুরোপুরি বন্ধ করতে হলে তার বিকল্প হিসেবে কিছু সামগ্রী সুলভ করতে হবে। যেমন, প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগের পরিবর্তে কাগজের প্যাকেট বা পাটের ব্যাগ বাজারে সহজলভ্য করতে হবে।
প্লাস্টিক দূষণের অনিবার্য পরিণতি থেকে মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে হলে উপরোক্ত পদক্ষেপগুলির সঙ্গে প্রয়োজন
মানুষের সচেতনতা যতদিন না পর্যন্ত প্লাস্টিক ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে জনমানসে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে, ততদিন আইন তৈরি করেও কোনো লাভ হবে না। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে এই কাজ করা যেতে পারে।
0 মন্তব্যসমূহ