আগরতলা, ১১ জানুয়ারি: রাজ্য সরকার গুরুত্ব সহকারে নেশা বিরোধী অভিযান ব্যাপকভাবে অব্যাহত রেখেছে। বিশেষ করে রাজ্যে বিভিন্ন নেশা সামগ্রী ব্যবহারের ব্যাপকতায় ছাত্র ও যুবসমাজের ক্ষতিকর প্রভাব লক্ষ্য করে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। এই অভিযানের ফলে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রচুর পরিমান বেআইনী নেশা সামগ্রী যেমন গাঁজা, কফসিরাপ, নেশার টেবলেট, হেরোইন ইত্যাদি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। এসকল সংশ্লিষ্ট মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি, সহযোগী ও নেশাদ্রব্য চালানকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাজ্য বিধানসভার অধিবেশনে বিধায়ক জিতেন্দ্র চৌধুরী কর্তৃক আনীত জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট দৃষ্টি আকর্ষণী নোটিশের উত্তরে এই তথ্য জানান মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর ডাঃ মানিক সাহা।
বিধানসভায় তথ্য সহকারে বিগত তিন বছরে ত্রিপুরা পুলিশের নেশা বিরোধী অভিযানের সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, ২০২১ সালে ৩৫২টি নথিভুক্ত মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে ৫০১ জন। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে ৪১ হাজার ৫৬৫ কেজি গাঁজা, ২ লক্ষ ৬ হাজার ৯৩৯ বোতল কফসিরাফ, ১৪ লক্ষ ১৯ হাজার ১৬৯টি ট্যাবলেট ও ৩ হাজার ৮৫০ গ্রাম হেরোইন। এই সময়ে গাঁজা গাছ ধ্বংস করা হয়েছে ৬২ লক্ষ ২০ হাজার ২২৮টি। ২০২২ সালে ৫৬২টি নথিভুক্ত মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে ৭৫৯ জন। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে ৭৯ হাজার ৩৭৭ কেজি গাঁজা, ১ লক্ষ ৭৩ হাজার ৩৭৫ বোতল কফসিরাফ, ২ লক্ষ ২০ হাজার ২১২টি ট্যাবলেট ও ৭ হাজার ৭৫ গ্রাম হেরোইন। এই সময়ে গাঁজা গাছ ধ্বংস করা হয়েছে ৪২ লক্ষ ৩৮ হাজার ৯১৮টি। এরপর ২০২৩ সালে ৬৩৩টি নথিভুক্ত মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে ১ হাজার ৫২ জন। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে ৪৬ হাজার ৬৩১ কেজি গাঁজা, ৩ লক্ষ ৮ হাজার ৫৮২ বোতল কফ সিরাফ, ৪ লক্ষ ৪৪ হাজার ১৬৬টি ট্যাবলেট ও ১৮ হাজার ৮৪৪ গ্রাম হেরোইন। এই সময়ে গাঁজা গাছ ধ্বংস করা হয়েছে ৬৮ লক্ষ ৭৩ হাজার ৯৩৫টি।
মুখ্যমন্ত্রী ডা: সাহা জানান, কেন্দ্রীয় সামাজিক ন্যায় এবং ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের নির্দেশানুসারে রাজ্যের বিভিন্ন দপ্তর যথা সমাজ কল্যাণ ও সমাজ শিক্ষা দপ্তর, স্বরাষ্ট্র দপ্তর, শিক্ষা দপ্তর, যুব বিষয়ক ও ক্রীড়া দপ্তর, নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো এবং বিভিন্ন এন.জি.ও-দের সহায়তায় একটি স্টেট লেভেল নেশামুক্ত ভারত ক্যাম্পেন কমিটি এবং পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় ডিস্ট্রিক্ট লেভেল নেশামুক্ত ভারত ক্যাম্পেন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নেশার পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা ও তার প্রতিরোধ সম্পর্কে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা। রাজ্যে নেশা দ্রব্য ব্যবহারের লাগামহীন বৃদ্ধি ও সেটা থেকে উত্তরনের লক্ষ্যে রাজ্যের যুব বিষয়ক ও ক্রীড়া দপ্তর 'খেলো ত্রিপুরা, সুস্থ ত্রিপুরা' প্রকল্পের অধীনে নেশামুক্ত ত্রিপুরা নামে ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে একটি কর্মসূচি গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে রাজ্যের প্রতিটি ব্লক, মহকুমা, জেলা, পৌরসভা, নগর পঞ্চায়েত এবং ক্লাবগুলিতে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করে যাচ্ছে। এছাড়াও প্রতিটি এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। তাছাড়া সন্ধ্যাবেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নাচ, গান, বক্তৃতা এবং নেশার কুফল সম্পর্কে নাটক অনুষ্ঠিত হয় । এগুলি ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে ফ্লেক্স, পোষ্টার, লিফলেট ইত্যাদির মাধ্যমেও জনসমাজে বিভিন্ন নেশা বিরোধী প্রচার চালানো হচ্ছে।
এর পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী জানান, শিক্ষাদপ্তর কেন্দ্রীয় সামাজিক ন্যায় এবং ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের নির্দেশানুসারে নবচেতনা মডিউলের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করছে। যাতে ছাত্রছাত্রীদের নেশা সম্পর্কে প্রতিরোধমূলক শিক্ষা দেওয়া যায়। ত্রিপুরা স্টেট এইডস্ কন্ট্রোল সোসাইটি কুমারঘাট, কৈলাশহর, দামছড়া, আমবাসা, জিরানিয়া ও জম্পুইয়ের মতো এলাকায় অপিওড সাবস্টিটিউশন থেরাপি (OST) সেন্টার চালু করেছে। সম্প্রতি ভাটি অভয়নগরেও এমন একটি সেন্টার চালু করা হয়েছে। এছাড়া রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক এবং নয়াদিল্লির এইমস এর আর্থিক সহায়তায় নরসিংগড়স্থিত আধুনিক মানসিক হাসপাতালে ২০১৯ সালের আগষ্ট মাসে ড্রাগ ট্রিটমেন্ট ক্লিনিক (DTC) নামে একটি ডেডিকেটেড ওপিডি ভিত্তিক আসক্তি ক্লিনিক খুলেছে। সরকারী আধুনিক মানসিক হাসপাতালে থাকা ডি-এডিকশন সেন্টারে নেশা আসক্তদের চিকিৎসার সুবিধা অর্থাৎ এডিকশন ট্রিটমেন্ট ফেসিলিটি (ATF) চালু করা হয়েছে। রাজ্যের অন্যান্য জেলাগুলিতেও এই সুবিধা চালু করার প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী আরো জানান, জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন ত্রিপুরার উদ্যোগে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে নেশামুক্ত ত্রিপুরা প্রচারাভিযান চালু হয়। এনএসএস ত্রিপুরা শাখা এই অভিযানে রাজ্যের মোট ২২টি সাধারন ডিগ্রী কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়েও মাদকাসক্তি সম্পর্কিত মেগা সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করেছে। এইচআইভি/এইডস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, কাউন্সিলিং ও টেস্টিং এর জন্য রাজ্যের ২৪টি হাসপাতালে ইন্টিগ্রেটেড কাউন্সেলিং এন্ড টেস্টিং সেন্টার (ICTC), ১৩৩টি হাসপাতালে ফেসিলিটি ইন্টিগ্রেটেড কাউন্সেলিং এন্ড টেস্টিং সেন্টার (FICTC), ৩টি পিপিপি-আইসিটিসি এবং একটি মোবাইল ইন্টিগ্রেটেড কাউন্সেলিং এন্ড টেস্টিং সেন্টার ভ্যান কাজ করছে।
ডা: সাহা জানান, রাজ্যে ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ প্রোগ্রামের আওতায় প্রথম সুইসাইডাল হেল্পলাইন [9863100639] চালু করা হয়েছে। যার মাধ্যমে নেশাসক্তদের সচেতন করার নিয়মিত প্রয়াস করা হয়ে থাকে। এছাড়াও অন্যান্য টেলি মানস হেল্পলাইন 14416/1800-891-4416 রাজ্যে চালু করা হয়েছে। রাজ্যের শিক্ষাদপ্তর, স্বরাষ্ট্র দপ্তর, সমাজ কল্যাণ ও সমাজ শিক্ষা দপ্তর, ক্রীড়া ও যুব কল্যাণ দপ্তর, পঞ্চায়েত দপ্তর, নগরোন্নয়ন দপ্তর, জনজাতি কল্যান দপ্তর, শিল্প ও বাণিজ্য দপ্তর, পরিবহণ দপ্তর, শ্রম দপ্তর সহ সংশ্লিষ্ট সরকারি এবং বেসরকারী নানা দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নেশা বিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচী রূপায়ণ করা হয়ে থাকে। এই প্রচারাভিযানে সাধারণ মানুষকেও যুক্ত করা হচ্ছে। এভাবেই মাদক ব্যবহারের প্রবণতা হ্রাস করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর এতে সুফলও পাওয়া যাচ্ছে।
0 মন্তব্যসমূহ