(একটি কারিগরী মুখবন্ধ উদ্যান বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র নাগীছড়া, পশ্চিম ত্রিপুরা)
একটি আদর্শ ফল হিসাবে আনারস সুপরিচিত, যা ত্রিপুরার ভৌগোলিক অবস্থানে দারুণভাবে সফল। যদিও ত্রিপুরার কৃষক ভাইয়েরা চিরাচরিত প্রথায়ই আনারস চাষ করে তথাপি রাজ্যের উপযুক্ত কৃষি আবহাওয়া আনারসের গড় উৎপাদনশীলতাকে জাতীয় উৎপাদনশীলতা থেকেও বাড়িয়ে নিয়েছে।
রাজ্যে মোট উৎপাদন যখন ১.০৬ লক্ষ মেঃ টন, সেখানে মাত্র ০.৩৫ লক্ষ টন আনারস ফল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। বাকী ০.৭১ লক্ষ মেঃ টন সহজেই সংরক্ষণ বা রপ্তানী করা যেতে পারে। রাজ্যের অভিজ্ঞতায় এটা খুবই পরিষ্কার যে, প্রায় মাস ব্যাপী আনারসের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকে, তারপরেই বাজারে আনারসের অভাব দেখা দেয়। তাই ফসল তোলার সময়কে বাড়িয়ে আনারসের উৎপাদন বাড়ানোর প্রকৌশলগত চিন্তাভাবনার এটাই উপযুক্ত সময়। নিম্নলিখিত বিজ্ঞানভিত্তিক কিছু পদক্ষেপ নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি।
১। অধিক ঘনত্বে আনারস চাষঃ
দ্বি-সারি পদ্ধতিতে ৯০ সে.মি. x ৬০ সে.মি. x ৩০ সে.মি. দূরত্বে প্রায় ৪৩,৫০০ টি আনারসের চারা হেক্টর প্রতি রোপন করা যায়, যা কাণিতে প্রায় ৬,৯৬০ টির প্রয়োজন হয়। চারার সংখ্যা এই পদ্ধতিতে বাড়িয়ে সার্বিক উৎপাদন কে বাড়ানো যেতে পারে, যেখানে রাজ্যের কৃষকেরা চিরাচরিত প্রথায় অনেক কম সংখ্যায় চারা রোপণ করে থাকে। অন্যান্য দেশে হেক্টর প্রতি প্রায় ৬৩,৫০০টি করেও চারা লাগায়, যদিও আমাদের রাজ্যের আবহাওয়ার তার উপযুক্ত বিজ্ঞানভিত্তিক সমীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। মাটি ও খাদ্য সংরক্ষণের বিষয়টিকে চিন্তা করে, আনারস অবশ্যই ঢালু জমির আড়াআড়িভাবে লাগানো উচিৎ।
খ) উপযুক্ত চারা নির্বাচন:
তেউর যা গাছের পাশ থেকে বেরোয়, স্লিপ যা ফলের নীচ থেকে বেরোয় আর ক্রাউন যা ফলের উপরে থাকে -এদের মধ্যে, তেউর থেকেই ফল তাড়াতাড়ি আশা করা যায়। তবে রোপণের ক্ষেত্রে তেউরের আকার বা ওজনের উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তেউর যেন ৪০০ গ্রামের কাছাকাছি হয়। কিউ জাতের আনারসের ক্ষেত্রে স্লিপ ব্যবহার করলে ৩৫০ গ্রাম হতে হবে, যা পরবর্তী সময়ে ফুল আনার জন্য, ঔষধ ছিটানোর ক্ষেত্রে উপকারে আসবে যার একটা বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তেউরগুলোর গোড়ার দিক উপরের দিকে রেখে কিছু দিনের জন্য ছায়াযুক্ত জায়গায় রেখে দিতে হবে। রোপণের আগে শুকিয়ে যাওয়া পাতাগুলি ফেলে দিয়ে ম্যানকোজেব জাতীয় ঔষধে ০.৩% দ্রবণে পাঁচ মিনিট ভিজিয়ে নিতে হবে।
গ) চারা রোপণের সময়:
যদিও রোপণের উপযুক্ত সময় মে-জুন মাস, কিন্তু রাজ্যের চাষীরা বর্ষার পরবর্তী জলকে কাজে লাগানোর জন্য আগষ্ট মাসের শেষ থেকে অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চারা রোপণ করে থাকেন। যদিও মে-জুন মাসে চারা পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য। কেননা আনারস গাছ তখন ফল পরিপক্কতার পথে থাকে এবং চাষীরা চারা তুলতে চান না, যদিও চারা তুলতে কোন বাধা নেই। তাই সব দিক বিবেচনা করে অর্থাৎ শীতকাল ও ঘোর বর্ষা বাদ দিয়ে চারার যোগানের উপর লক্ষ রেখে আগষ্ট মাসের শেষ থেকে অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আমাদের রাজ্যে চারা লাগানো যেতে পারে।
ঘ) সার ব্যবহার:
আনারস চাষে প্রচুর পরিমানে নাইট্রোজেন ও পটাশের দরকার, যদিও রাজ্যের চাষীরা আনারস চাষে কোন রকম সার ব্যবহার করেন না। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ও উর্বর মাটিকে ভালভাবে কাজে লাগিয়ে চাষ করে আসছেন। তবে পরীক্ষালব্ধ হিসাবে প্রতি গাছে প্রাক্ বর্ষায় ইউরিয়া-২০ গ্রাম, সিঙ্গল সুপার ফসফেট-২৫ গ্রাম এবং মিউরেট অফ পটাশ-১৬ গ্রাম প্রয়োগে ফলের আকার বৃদ্ধি পায়।
ঙ) মাটি তোলা:
গাছকে সোজা রাখতে গোড়ায় মাটি তুলে দিয়ে, ফলের নীচের দিকের স্লিপগুলোকে ফেলে দিতে হবে, যা ফলের আকার এবং তাড়াতাড়ি পরিপক্কতার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে।
চ) রাসায়নিক উপায়ে ফুল ফোটানোঃ
আনারস চাষে অসম ফুল আসা একটি অন্যতম সমস্যা। কেবলমাত্র ৩০-৪০% গাছে প্রাকৃতিকভাবে ফুল ফোটে। তাই বেশী পরিমাণ গাছে ফুল ফোটানোর জন্য নিম্নলিখিত যে কোন পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
সময় ঔষধ ও মাত্রা
সেপ্টেম্বর-জানুয়ারী: ন্যাপথালিক এসিটিক এ্যাসিড (NAA) প্লানোফিক্স ১ মিঃলিঃ প্রতি ৪.৫ লিটার জলে।
মার্চ-মে: ইথরেল ১০ পি.পি.এম. (২.৫ মিঃলি+ ১০০ লিটার জল) + ২% ইউরিয়া + ০.০৪% সোডিয়াম কর্বোনেট।
অন্যান্য সময় : ইথরেল ২৫ পি.পি.এম. (৬.২৫ মিঃলিঃ + ১০০ লিটার জল) ২% ইউরিয়া + ০.০৪% সোডিয়াম কর্বোনেট।
২) প্রয়োগের সময়:
বাজারের বিক্রির উপযোগী আনারস পাওয়ার জন্য রাসায়নিক ঔষধ অবশ্যই ৩৫-৪০ টি পাতা রয়েছে এমন অবস্থায় দিতে হবে। (ডি-পাতার (D-Leaf) ওজন যেন গড়ে ৯০ গ্রাম হয়)।
৩) প্রয়োগ বিধিঃ
প্রয়োজনীয় মিশ্রণ তৈরী করার পর ৫০ মিঃলিঃ তরল গাছের কেন্দ্রে ঢেলে দিতে হবে। বর্ষাকালে প্রয়োগের সফলতা কম। প্রয়োগের পর ২৪ থেকে ৩৬ ঘন্টা পর্যন্ত বৃষ্টি না হওয়া বাঞ্ছনীয়। না হলে, প্রয়োগের পুনরাবৃত্তি করতে হবে। প্রয়োগের ৬ থেকে ৭ সপ্তাহ বাদে ফুল আসতে শুরু করে।
ছ) সমস্ত বছর ধরে আনারসের যোগানঃ
ধাপে ধাপে ফসল পাওয়ার জন্য চারা রোপন একটি নির্দিষ্ট সময় পরে পরে করা যেতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে চারার আকার ও আয়তনের পরিবর্ত্তন ঘটিয়েও করা যেতে পারে। এপ্রিল মাস থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রাসায়নিক ঔষধ সাত দিন পর পর প্রয়োগের মাধ্যমে আনারস তোলা যেতে পারে। ফুল আসার তিন থেকে সাড়ে তিন মাসের মধ্যে ফসল তোলা যেতে পারে। তাই সাধারণভাবে ফসল আসার কমপক্ষে পাঁচ মাস আগে থেকে রাসায়নিক ঔষধ ব্যবহার করে ফুল ফোটানোর চেষ্টা করতে হবে। তবে মনে রাখবেন, জমিতে যতই একই আকার আয়তনের গাছ থাকবে, সেখানে ততটাই কাজ করবে। আর, তা একমাত্র একই আকার ও আয়তনের চারা রোপনের মাধ্যমে সম্ভব।
কৃত্তিম উপায়ে ফুল ফোটানোর সুবিধাঃ
১) গাছের অঙ্গজ দশাকে কমিয়ে চাষের খরচ কমানো যায়।
২) নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে ফসল পাওয়া যায়।
৩) নিশ্চিত উৎপাদন।
৪) অসময়ে উৎপাদনের মাধ্যমে অধিক লাভ।
0 মন্তব্যসমূহ