স্ট্রবেরী চাষের কারিগরী মুখবন্ধ :
ভারতবর্ষে চাষযোগ্য বিভিন্ন অর্থকরী ফসলগুলোর মধ্যে স্ট্রবেরী একটি অন্যতম অর্থকরী ফসল (Cash Crop)। যদিও স্ট্রবেরী শীতপ্রধান অঞ্চলের ফসল, তবে আজকাল নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলেও এর চাষ সম্ভব। ভারতবর্ষের মহাবালেশ্বর, নৈনিতাল, বেঙ্গালোর এবং কালিমপণ্ড-এ এটি ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। ত্রিপুরাতে স্ট্রবেরী চাষের এলাকা ও পরিমাণ এখনো খুবই সীমিত। তবে আজকাল উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাকী রাজ্যগুলিতে ব্যাপক হারে স্ট্রবেরী চাষের প্রচেষ্টা চলছে।
স্ট্রবেরী একটি এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি (Vit- C) এবং ই(Vit-E), বিটা কেরোটিন, পটাশিয়াম, ফলিক এসিড, ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স, আয়োডিন ও জিঙ্ক পাওয়া যায়। তাছাড়া এতে স্বল্প মাত্রায় প্রোটিন, সুগার ও ক্যালরি থাকে এবং চর্বি ও কোলেস্টেরল মুক্ত হওয়ায় স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারি। যে কোন ব্যক্তি বাড়িতে ৮-১০ খানা স্ট্রবেরী গাছ লাগিয়েও নিজের চাহিদা পূরণ করতে পারেন।
আবহাওয়া: ত্রিপুরা রাজ্যের শীতকালীন আবহাওয়া স্ট্রবেরি চাষের জন্য খুবই উপযুক্ত। ত্রিপুরার জলবায়ুতে অক্টোবর এবং নভেম্বর মাস হল চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। তবে নভেম্বর মাসের পরেও চারা রোপণ করা যায়, কিন্তু এতে অনেক সময় ফলন হ্রাস পায়।
জমি নির্বাচন: উত্তম জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা যুক্ত ও প্রচুর জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ রৌদ্রোজ্জ্বল খোলা জমি (pH 5.6-6.5) স্ট্রবেরি চাষের জন্য খুবই উপযুক্ত। যে সমস্ত জমিতে পূর্বে টমেটো, বেগুন, আলু চাষ করা হয়েছে সেখানে স্ট্রবেরি চাষ করা উচিত নয়।
স্থান নির্বাচন : ১. খোলা জমি ২. গ্রীণ-হাউস ৩. নেট-হাউস ৪. টব, বড় পলিব্যাগ, ঝুলানো বাস্কেট ইত্যাদি।
বাণিজ্যিক ভাবে চাষাবাদ করার জন্য রৌদ্রোজ্জ্বল খোলা জমি উপযুক্ত। স্ট্রবেরি গাছ অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং অগভীর শেকড়যুক্ত হওয়ায় বর্ষাকালে খোলা জমির গাছগুলি সহজে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তবে আজকাল গ্রীণ-হাউস এবং নেট-হাউজে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে স্ট্রবেরির ব্যাপক চাষবাস পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়া টব, বড় পলিব্যাগ, ঝুলানো বাস্কেটে সীমিত জায়গায় সৌখিনভাবে বাড়িঘরে এর চাষ। করা সম্ভব।
জমি তৈরি: জমিকে আগাছা মুক্ত করে ২-৩ বার চাষ দিয়ে ভালোভাবে মাটি তৈরী করে নিতে হবে। দ্বিতীয় চাষের পূর্বে জমিতে হেক্টর প্রতি ৫০ মেঃ টন গোবর/জৈব সার এবং ৩০ কেজি (প্রতি বর্গ মিটারে ৩ গ্রাম হিসাবে) ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দিতে হবে। ১৫ দিন পর শেষ চাষ দিয়ে জমি তৈরী করে নিতে হবে।
সারের মাত্রা ও প্রয়োগ: প্রতি হেক্টর জমির জন্য।
১. ইউরিয়া : ১৮০ কেজি
২. সুপার ফসফেট : ৩৫০ কেজি
৩. মিউরেট অব পটাশ : ১০০ কেজি
সমস্ত সুপার ফসফেট জমি তৈরীর সময় ছিটিয়ে দিতে হবে। অর্ধেক পরিমাণ ইউরিয়া সার চারা লাগানোর ২১ দিন পর জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। বাকী অর্ধেক ইউরিয়া ও সমস্ত পটাস সার ফুল আসার সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
স্ট্রবেরি চাষে ফলের গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে আজকাল জমিতে পলিমালচ্ ব্যবহার করা হয়। সেজন্য মাঠে শুধু সুপার ফসফেট সারই ব্যবহার করা সম্ভব হয়ে উঠে। বাকী ২টি সারের চাহিদা পরবর্তী পর্যায়ে পাতায় এন: পিঃ কে সার (১৯:৯: ৪৫ এবং ০০:০০: ৫০) ছিটিয়ে পূরণ করা হয়।
জমিতে বেড তৈরী: জমিতে উত্তর-দক্ষিণে ১ মিটার চওড়া, ৩০ সেমি উঁচু বেড তৈরী করতে হবে এবং প্রতি দুইটি বেডের মাঝখানে ৫০ সেমি করে চলাচলের রাস্তা রাখতে হবে। স্ট্রবেরি ফল অত্যন্ত সংবেদনশীল হওয়ায় মাটির সংস্পর্শে আসামাত্র রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই বেড তৈরীর পর সমস্ত বেডকে ২৫ মাইক্রন পলিথিন (পলিমালচ্) দিয়ে টান টান করে ঢেকে চারপাশে মাটি চাপা দিয়ে স্ট্রবেরি চাষ করলে ফসলকে রোগাক্রমনের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
ত্রিপুরার জন্য নির্বাচিত জাত: ১ ফেস্টিবল ২. ক্যামারোসা ৩. সুইট চার্লি।
স্ট্রবেরি চারা: ভাল গুনগত মানের উচ্চ ফলনশীল জাতের চারা নির্ভরযোগ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করা উচিত। স্বীকৃত নার্সারী থেকে চারা সংগ্রহে সাধারণত রোগ-পোকার আক্রমন অনেক কম হয়।
সাধারণত দু-ধরনের চারা পাওয়া যায়:
১. প্লাগঃ প্রো-ট্রেতে বসানো শেকড় সহ ছোট চারা (টিস্যু কালচারের চারা এই পদ্ধতিতে তৈরী করা হয়)।
২. বেয়ার রুটেড: পাতা ছাড়া লম্বা শেকড় যুক্ত কাণ্ড।
সরকারিভাবে নাগীছড়া উদ্যান ও বাগিচা ফসল গবেষণা কেন্দ্রে চারা উৎপাদন করার জন্য একটি ছোট নার্সারির পরিকল্পনা আছে।
স্ট্রবেরি চারা তৈরী: ত্রিপুরায় স্ট্রবেরি উৎপাদনের উপযুক্ত আবহাওয়া থাকা সত্ত্বেও প্রধান প্রতিবন্ধকতা হল সঠিক সময়ে চারা হাতের কাছে পাওয়া। আম, পেয়ারা ইত্যাদি ফলের প্রচুর নার্সারি গড়ে উঠলে ও স্ট্রবেরির চারা উৎপাদনের কোন নার্সারি না থাকার দরুন রাজ্যের বাইরে থেকে চারা আমদানি করতে হয়। স্ট্রবেরি চাষের জন্য অনেক ধরনের চারা উৎপাদন করা যায় যার মধ্যে 'প্লাগ চারা' সবচেয়ে ভাল। প্লাগ-চারা সহজে ছোট গ্রীণ-হাউসেও তৈরী করা যায়।
১) মা গাছ ও স্থান নির্বাচন: বাণিজ্যিক ভাবে 'প্লাগ চারা' তৈরী করার জন্য প্রথম পদক্ষেপ হল রানার কুড়ি (Runner Tips) তৈরীর জন্য রোগমুক্ত মা গাছ নির্বাচন। মা গাছগুলিকে জীবানুমুক্ত ও জৈব সার সমৃদ্ধ মাটিতে, ট্রেতে বা গ্রো-ব্যাগে লাগিয়ে একটু উঁচুতে (১.৫-৩ ফুট) রাখতে হবে। বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোনভাবেই রানার কুড়ি মাটির সংস্পর্শে না আসে। তাহলে রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গ্রীণ হাউজে পলিমালচ ব্যবহার করে তা করা যায়। রানার কুড়ি বের হওয়ার জন্য উষ্ণ আবহাওয়ার দরকার, তাই গ্রীষ্ম কালে প্রচুর রানার কুড়ি তৈরী হয়।
মা গাছ লাগানোর পর প্রথম রাণার কুড়ি বের হতে ৬-৮ সপ্তাহ সময় লাগে। মা গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে রাণার কুড়ির উৎপাদনও বাড়তে থাকে। ত্রিপুরাতে জুন-জুলাই মাস থেকেই রাণার গাছে আসতে শুরু করে। তবে কুড়ির সংখ্যা নির্ভর করে ভ্যারাইটি বা জাতের উপর। গাছগুলিকে সঠিক যত্ন ও প্রয়োজনীয় জল সরবরাহ করে যেতে হবে। রাণার কুড়ি (Runner Tips) যেহেতু গাছের অঙ্গজ প্রজননের (Vegetative Reproduction) মাধ্যম, তাই উপযুক্ত সার প্রয়োগের মাধ্যমে রাণার কুড়ির উৎপাদন ত্বরান্বিত করা যায়।
২) রাণার কুড়ি সংগ্রহ ও চারা উৎপাদন: যখন কুড়ির নীচের দিকে সাদা বা বাদামী শেকড় বের হয় (১/২ ইঞ্চি থেকে কম) এবং ২-৩ টি পাতা (২.৫ - ৩.৫ ইঞ্চি) থাকে তখন তা সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। সঠিক যত্নে ১০-১৫ দিন পর পর কুড়ি সংগ্রহ করা যায়।
রাণার কুড়ি সংগ্রহের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন পাতাগুলি নষ্ট না হয় এবং ১/২ ইঞ্চি রাণার ঐ কুড়ির গায়ে থাকে যাতে তা প্রো-ট্রেতে লাগানোর সময় কাজে আসে। প্রো-ট্রে ভার্মিকোলাইট/পারলাইট দিয়ে ভরে নিতে হবে। কুড়িকে এমনভাবে প্রো-ট্রেতে লাগাতে হবে যেন শেকড় ও রানারের অংশ শুধু হালকা গভীরে প্রবেশ করে। প্লাস্টিকের ক্লীপ দিয়ে রানার-কুড়িকে আটকে দিতে হবে। রানার কুড়ি লাগানোর পর বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন পাতাগুলি সবসময় সতেজ থাকে, যার জন্য কুয়াশা পদ্ধতিতে (Misting System) জলসেচ একান্ত জরুরী। প্রথমে কিছুক্ষণ পর পর এবং তারপর হালকাভাবে সেচ দিতে হবে। চারাগুলিকে গ্রীণহাউজে ২ সপ্তাহ রেখে শক্ত করতে হবে। ৪ সপ্তাহে প্রচুর শেকড় ছড়িয়ে ভাল চারা তৈরী হয়ে যাবে। অত্যাধিক আর্দ্রতার জন্য ছত্রাকের আক্রমণ ঘটলে ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।
স্ট্রবেরি চারা তৈরীর সহজ পদ্ধতিঃ ফল আসার পর গাছগুলিকে উপযুক্ত পরিচর্যা ও সার প্রয়োগ করলে গাছ থেকে রাণার বা ধাবক বের হতে শুরু করে। রানার বা ধাবকের মাথায়। ছোট্ট চারা বের হলে তাকে সার ও মাটি মিশ্রিত পলিব্যাগের মাঝে সেট করে ক্লিপ দিয়ে আটকে দিতে হবে। পরবর্তীতে এটি একটি চারা হবে। এভাবে একটি গাছ থেকে প্রচুর চারা সংগ্রহ করা যায়।
চারার পরিমাণ: সারি থেকে সারি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্বের উপর নির্ভর করে চারার পরিমাণ নির্ধারণ করতে হয়। সাধারণত ৪০ সেমি x ৪০ সেমি (সারি থেকে সারি এবং গাছ থেকে গাছ) দূরত্বের জন্য কানি প্রতি চারার দরকা ৩৮৫২টি। পরবর্তীতে শূন্যস্থান পূরণ সহ মোট ৪০০০টি চারার দরকার।
সঠিক দূরত্বে চারা লাগানো: বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে চারা জমিতে লাগিয়ে ফেলতে হবে। সাধারণত ১ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট বেডে দ্বি-সারি পদ্ধতিতে চারা লাগানো হয়। এই পদ্ধতিতে প্রথমে বেডের উপর পলিমালচ্ বিছিয়ে দুই কিনারা থেকে ৩০ সেমি দূরত্বে বেডের দৈর্ঘ্য বরাবর পলিমাচে ৪০ সেমিঃ অন্তর্বর্তী দূরত্বে দুইটি লাইন/সারি টানতে হবে। এবার প্রতি সারিতে দৈর্ঘ্য বরাবর পলিমাচে প্রতি ৪০ সেমি দূরত্বে ধারানো ছুরি দিয়ে তিন ইঞ্চি লম্বা করে "+" চিহ্ন কেটে রাখতে হবে। পলিমারে কাটা অংশে চারাগুলিকে হালকাভাবে বসিয়ে শুধু শেকড় ও শক্ত কাণ্ডকে মাটির ভিতর পুঁতে দিতে হবে। বিকেলবেলা হচ্ছে চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। চারা লাগানোর পর প্রতি লিটার জলে দুই গ্রাম বেভিস্টিন পাউডার মিশিয়ে চারাগুলোতে স্প্রে করতে হবে। পরবর্তীতে দুই বেডের মাঝে সেচ দিতে হবে।
সার প্রয়োগ: চারা লাগানো ৩০-৩৫ দিন পর এন:পি:কে (১৯:১৯:১৯) সার ১.৫ গ্রাম/লিটারে মিশিয়ে প্রতি ১৫ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে। ফল আসার সময় এন: পি: কে (১৩:০:৪৫) সার ১.৫ গ্রাম/লিটার জলে মিশিয়ে প্রতি ১৫ দিন পরপর শ্রে করতে হবে।
সতর্কতা: স্ট্রবেরি চাষ সাধারণত প্রায় জৈবিক উপায়ে (Semi Organic) করা হয়। ফলের গায়ে কোন খোসা না থাকার দরুন এবং পাকা ফল সরাসরি খাওয়া হয় বলে এই ফল চাষে কীটনাশক ব্যবহার না করাই শ্রেয়। তবে ফুল আসার পূর্ব পর্যন্ত কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
ফুল আসার সময়: চারা লাগানোর ২ মাস পর থেকে ফুল ফুটতে শুরু করে এবং পরবর্তী ৪-৫ মাস পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে।
ফল সংগ্রহ: ফলগুলি যখন ৭০-৮০ শতাংশ লাল হয়ে উঠে তখন সংগ্রহ করে নিতে হবে এবং ঠাণ্ডা জায়গায় ছড়িয়ে রাখতে হবে। পরে ফলগুলিকে বাতাস নিরোধক (Air Tight) পলিব্যাগে সিল করে ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ফ্রিজে রেখে ৪-৫ দিন পর্যন্ত সংরক্ষন করে রাখা যায়। তবে এই ফল অত্যন্ত কোমল ও সহজে পচনশীল হওয়ার দরুন খুব শীঘ্র বাজারজাত করাই শ্রেয়।
উৎপাদন: স্ট্রবেরির উৎপাদন সাধারণত প্রতি একক জমিতে গাছের সংখ্যা, জাত ও সঠিক পরিচর্যার উপর নির্ভরশীল। ভারতবর্ষে ব্যাণিজ্যিক চাষ এলাকায় প্রতিগাছের গড় উৎপাদন ৪০০ গ্রাম।
বাজার জাতকরণ: স্ট্রবেরি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও সুস্বাদু ফল হওয়ার সুবাদে বাজারে এর চাহিদা আছে। খোলা বাজারে স্ট্রবেরি অনায়াসেই ৩০০-৪০০ টাকা প্রতি কিলো দরে বিক্রি করা সম্ভব।
0 মন্তব্যসমূহ