ড. হৈমন্তী ভট্টাচার্জী
শিশুকালই হচ্ছে ভবিষ্যত জীবনের ভিত্তিভূমি। এই ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে ভবিষ্যতের আদর্শ সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে মায়ের ভূমিকাই প্রধান ও মুখ্য। একজন সচেতন, বিজ্ঞ মা-ই পারেন তার সন্তানকে যথার্থ মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে। একজন শিশুর সবচেয়ে বড় সাথী হচ্ছে তার মা। মা শুধু একজন জন্মদাত্রী জননীই নন, সুন্দর চরিত্রবান সন্তান তৈরী করার কারিগরও বটে।
মায়ের গর্ভে থাকার সময় থেকেই শিশু তার মাতৃসত্তাকে অনুধাবন, অনুকরণ করে। মায়ের সব কাজ-কর্ম, চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতি, আচরণ, মূল্যবোধ শিশুর ওপর প্রভাব ফেলে। কারণ শিক্ষাকালীন নব্বইভাগ সময়ই শিশু মায়ের কাছেই থাকে। শিশুর প্রথম ও প্রকৃত শিক্ষক ও মা। একজন শিশুর শিক্ষার হাতেখড়ি মায়ের কাছ থেকেই হয়।
মাই প্রথম শিশুকে মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। কথা বলা শেখার সময় মা সারাক্ষণ তার সন্তানের সঙ্গে কথা বলে থাকেন। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসহ বিভিন্ন জিনিসের নাম শিখিয়ে থাকেন। যৌথ পরিবারে কাজটি অনেকটা সহজ হলেও একক পরিবারে মাকেই দায়িত্বটা পালন করতে হয়।
মায়ের মুখের ভাষাই শিশু প্রথম রপ্ত করতে থাকে। এমনকি শৈশবকাল থেকেই শিশু মায়ের প্রত্যেকটি আচরণ এবং কথাবার্তা অনুকরণ করতে শেখে। কারণ শিশুরা অত্যন্ত অনুকরণপ্রিয়। সবকিছুকে অনুকরণ করতে সে ভালোবাসে। তাই মাকে খুব সতর্কতার সঙ্গে এ সময়ে শিশুর লালনপালন করতে হবে। মায়ের মাধ্যমেই শিশু তার পরিবার ও পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে। একজন শিশুর মানসিক গঠনে এবং চারিত্রিক বিকাশে মায়ের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
মা যত নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও দরদের সঙ্গে তার শিশুর পরিচর্যা ও লেখাপড়া করিয়ে থাকেন তা আর অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়। আসলে মায়ের বিকল্প হয় না। বই-খাতা-কলমসহ প্রয়োজনীয় সব কিছু দিয়ে ব্যাগ প্রস্তুত করে সময় মতো মাথায় সিঁথি কেটে ও পরিপাটি করে স্কুলে পৌঁছানো কেবল মায়ের পক্ষেই সম্ভব। মাত্রাতিরিক্ত স্নেহ আবার কোমলমতি শিশুকে স্বেচ্ছাচারী করে তোলে। সেদিকেও মাকে সচেতন থাকতে হবে। শিশুকে কখনো বেশী শাসন করা উচিত নয়। লঘু পাপে গুরুদণ্ড অনেক সময় শিশুকে আরো জেদি করে তোলে। মা যদি সহানুভূতির সঙ্গে শিশুকে সংশোধন করার চেষ্টা করেন তবে সে চেষ্টা শারীরিক শাস্তির চেয়ে অনেক বেশী সুফল বয়ে আনে।
শিশুর চরিত্র গঠনের দায়িত্বটাও মূলত মাকেই পালন করতে হয়। পরিবারে বড়দের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা এবং ছোটদের প্রতি আদর স্নেহ প্রদর্শন করে সন্তানের সামনে মাকেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হয়। অতিরিক্ত আদর-স্নেহ বশে তাদের অন্যায় আবদার মেনে নেয়া উচিত নয়। চাওয়া মাত্র চাহিদা পূরণের অভ্যাস শিশুকে জেদি করে তোলে। তাই নিজ নিজ সামর্থ্যর অনুকুলে শিশুর আবদার পূরণ করা উচিত। শত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও শিশুর চরিত্র গঠনে প্রত্যেক মাকে কিছু সময় অবশ্যই ব্যয় করতে হবে।
অন্তরের সোহাগ এবং চোখের শাসন দুয়ে মিলে সন্তানকে সঠিক পথ নির্দেশনা দিয়ে চালিত করার ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকা অপরিসীম।
শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যত। কাজেই আদর্শ সমাজ ও উন্নত পরিবেশে শিশুদের গড়ে তুলতে হবে। শিশুরা কেমন করে উন্নত চরিত্র এবং আদর্শের অধিকারী হতে পারে সে বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। শিশুদের আদর্শবাদী হিসেবে গড়ে তুলতে না পাড়লে আদর্শ সমাজ নির্মাণ সম্ভব হবে না। যদি কোনো শিশুর চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়, তবে এর কারণে সে নিজেই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে না; বরং এ ক্ষতির প্রভাবে পরিবার, সমাজ এবং রাস্ট্রের অকল্যাণ ডেকে আনবে। কাজেই শিশুদের চরিত্র গঠনে অভিভাবকদের বিশেষত মাকে সদা সচেতন থাকা আবশ্যক।
0 মন্তব্যসমূহ