ড.হৈমন্তী ভট্টাচার্জী
সকলের তরে সকলে আমরা/প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।” পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়া, সহযােগিতা ও সহানুভূতির ভিত্তিতে সমাজ গড়ে ওঠে। সমাজে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জন্য দায়বদ্ধ থাকে। সকলের উচিত সকলের প্রয়ােজনে পাশে দাঁড়ানাে। কেন-না, পরার্থে যারা জীবন উৎসর্গ করে, তারা মহৎ। রক্তদানও এক মহৎ কর্ম। তাই রক্তদান হল প্রাণদান।
দানধর্ম শ্রেষ্ঠ ধর্ম— একথা ঠিকই কিন্তু রক্তদান কেন মহৎ কর্তব্য তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। উত্তরে বলা যেতে পারে, রক্ত যেহেতু জীবন বাঁচায় তাই রক্তদান তো জীবন দানের সামিল। যা দান করলে দাতার কোন ক্ষতি হয় না অথচ গ্রহীতার পরম উপকার হয় তা প্রকৃত দান এবং এই দান এক মহৎ কর্তব্য, এ কারণে যে তার দ্বারা একজন মৃত্যু পথযাত্রী প্রাণ ফিরে পায়।রক্ত দেয় পুনজীবন এবং দীর্ঘ জীবনও। মানুষের দেহে প্রয়ােজনের তুলনায় কিছু বেশি রক্ত সংরক্ষিত থাকে। এই অতিরিক্ত রক্তদানের মধ্য দিয়ে যেমন একটি মানুষ পুনর্জীবন লাভ করে, তেমনি যে রক্তদান করে তার শরীরও সুস্থ থাকে।
রক্তদানের উপকারিতা
নিয়মিত স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে নিজের শরীরে বড় কোনো রোগ আছে কিনা তা বিনা খরচে জানা যায়। যেমন : হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, সিফিলিস, এইচআইভি (এইডস) ইত্যাদি। প্রতি পাইন্ট (এক গ্যালনের আট ভাগের এক ভাগ) রক্ত দিলে ৬৫০ ক্যালরি করে শক্তি খরচ হয়। অর্থাৎ ওজন কমানোর ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
রক্তের প্রয়োজনীয়তা
রক্তের অপর নাম জীবন কারণ রক্ত হল প্রাণের উৎস। আমাদের প্রাণের স্পন্দন, পরমায়ু শক্তি রক্তের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। একজন হঠাৎ দুর্ঘটনা গ্রস্ত হলে এবং সেই দুর্ঘটনায় ক্ষতের সৃষ্টি হলে রক্তক্ষরণ হতে হতে দেহ রক্তহীন হয়ে পড়ে, তখন বাইরে থেকে রক্ত দিয়ে জীবন বাঁচানো সম্ভব, অস্ত্রোপচার এর সময় অনেক সময় আমাদের রক্তের প্রয়োজন হয় এবং বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার কারণেও কিন্তু আমাদের রক্তের প্রয়োজন। রক্ত হল মানুষের শরীরের অত্যাবশ্যক সামগ্রী, প্রাণশক্তির দ্যোতক। মানুষের ধমনিতে রক্তপ্রবাহ অবাধ থাকলে, দেহ সুস্থ থাকে। রােগভােগের কারণে বা দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে রক্তক্ষরণ হলে শরীরে রক্তের ঘাটতি পড়ে—তা পূরণ করার জন্য রক্তের প্রয়ােজন জরুরি। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মানবদেহের রক্তকে চারটি গ্রুপে ভাগ করেছেন—A, B, AB, O। রক্তের প্রয়ােজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে যার রক্তের প্রয়ােজন সে গ্রহণ করতে পারে। অন্য গ্রুপের রক্ত বা অবিশুদ্ধ রক্ত দেহে সঞ্চারিত হলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। রােগী মারাও যেতে পারে।
রক্তদানের গুরুত্ব
আধুনিক জীবনে একটি মহৎ দান হিসাবে বিবেচিত। কারণ একজন মানুষের শরীরে রক্ত যেভাবে সঞ্চিত হয়, তার সবটা শরীরে প্রয়োজন হয়না। ফলে অতিরিক্ত রক্ত রক্তরসে পরিণত হয়ে তা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে রক্তদানের জন্য শরীরের তো ক্ষতি হয়না, বরং একজন জীবন ফিরে পেতে পাবে।
রক্ত সংরক্ষণ
যে উদ্দেশ্যে রক্তদান, উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে হলে চাই রক্ত সংরক্ষণ। প্রয়োজনের সময় কাজে লাগাতে গেলে রক্তের সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। ফলে এই সংরক্ষিত রক্ত প্রয়োজন হলে মানুষ পেতে পাবেন। Blood bank গুলি রক্ত সংরক্ষনের জন্য রক্ত গ্রহণের কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকেন।
রক্তদান আমাদের কর্তব্য কেন
আমরা যেহেতু সমাজবদ্ধ জীব তাই অপরের প্রয়োজনে নিজের বাড়তি জিনিস দান করা নিঃসন্দেহে কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। তাতে অপবের যেমন লাভ হয় তেমনি দাতাও মানসিক প্রশান্তি অনুভব করে। প্রত্যেক সমাজ সচেতন নীরোগ ব্যাক্তি রক্তদানের দ্বারা সামাজিক কর্তব্য সাধন করতে পাবেন। একটি মানুষের প্রাণ বাঁচবে আমার রক্তের দ্বারা এতে আমার শরীরে কোন ক্ষতি হবে না— এই মানসিকতা গ্রহণ করতে হবে আমাদের। এজন্য বিভিন্ন মেলায় উৎসব অনুষ্ঠানে রক্তদানের সুফল সম্বন্ধে প্রচার করা জরুরী। ছাত্র ও যুব সমাজকে এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।
রক্তদান শিবির
বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান কিংবা ক্লাবের পক্ষ থেকে এখন গ্রামাঞ্চলে ও রক্তদান শিবির হয়ে থাকে। কোন উৎসব উপলক্ষেও আবার এই শিবির হয়। বিশেষ করে রক্তের অভাব ঘটে গ্রীষ্মকালে। প্রচন্ড দাবদাহে পেশাদার রক্ত দাতা ছাড়া অন্য কেউ রক্ত দিতে চায় না বলেই গ্রীষ্মকালে রক্তদান শিবির করতে উৎসাহ দেওয়া হয়।
নানা প্রতিষ্ঠান এবং স্বেচ্ছাসেবী জনকল্যাণকারী সংস্থা রক্তদান শিবির খুলে রক্ত সংগ্রহ করে থাকে। মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বছরে একাধিকবার রক্তদান শিবির খুলে সাধারণ মানুষকে রক্তদানে অনুপ্রাণিত করে তুলছে। জনসাধারণকে রক্তদানের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে অবহিত করার জন্য দূরদর্শন, বেতার, সংবাদপত্র এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান উল্লেখযােগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে চলেছে।
অবশেষে বলা যায় রক্তদান সেবাধর্মের অঙ্গ। রক্তদানের মধ্য দিয়ে শুধু অপরের জীবন রক্ষিত হয় না, নিজেও সুস্থ ও দীর্ঘায়ুর অধিকারী হওয়া যায়। রক্তের কোনাে জাত-ধর্ম নেই। হিন্দু-মুসলমান ভেদ নেই, সাম্প্রদায়িকতা নেই। সব রক্তের রং-ই লাল। তাই রক্তদানের ভিতর দিয়ে আমাদের ভিতর এক অসাধারণ মানব-ঐক্য গড়ে ওঠে। স্থাপিত হয় এক আত্মীয়তা। এই বিশেষ ঐক্যটি উপেক্ষণীয় নয়। মনুষ্যত্বের অবক্ষয়ের এই যুগে রক্তদানের এই মহান ব্রতকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়ােজন ।
"দেহের একটু রক্ত দিলে যদি বাঁচে একটি প্রাণ,
ধন্য হবে জনম তােমার, মহৎ তােমার দান।”
0 মন্তব্যসমূহ