সাতবোনের দেশের দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম কন্যা হলো আমাদের এই রাজ্য ত্রিপুরা। ত্রিপুরার প্রত্যন্ত অঞ্চলের উপজাতি জনগোষ্ঠীরা প্রথম কৃষি শুরু করে বন জঙ্গল কেটে, পুড়িয়ে ও প্রতি বছর স্থান পরিবর্তন করে। এই যাযাবর পদ্ধতির চাষ ব্যবস্থাই পরিচিত "জুম চাষ" বলে এবং পর সেই সকল উপজাতি জনগোষ্ঠী পরিচিত হয় 'জুমিয়া' নামে।
বর্তমানে জুমিয়াদের মধ্যে কিছু পরিবার আছেন যারা প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসরণ করেন। তাঁদের বলা হয় 'গোঁড়া জুমিয়া' এবং যারা সমতলে চাষ আবাদ, পশুপালন ইত্যাদির সঙ্গে জুম চাষ করেন তাঁদের বলে 'আংশিক জুমিয়া'। বর্তমানে কৃষি জমি সংকোচনের ফলে ত্রিপুরা রাজ্যে জুম চক্র ১৫-২০ বছর থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২-৩ বছরে। ক্রমশঃ হ্রাস পাচ্ছে ফসলের উৎপাদনশীলতা, বীজের গুণগত মান, রোগ-পোকার আক্রমণের সহনশীলতা।
ত্রিপুরা সরকারের উদ্যান ও ভূমি সংরক্ষণ দপ্তরের অন্তর্গত নাগীছড়ায় অবস্থিত হর্টিকালচার রিসার্চ কমপ্লেক্স এই আঙ্গিকে এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। জুমিয়াদের মধ্যে সবচেয়ে লোকপ্রিয় সব্জী যেমন মিষ্টি-কুমড়া, খাকলু, লঙ্কা ইত্যাদির উৎপাদনশীলতা, বীজের গুণগত মান রোগ সহনশীলতা ইত্যাদি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন ও করছেন। কৃষি জমি সংকোচনের ফলে স্বল্প পরিসর জমিতে অধিক উৎপাদনের জন্যে এক ফসল জুম সব্জীকে 'দো-ফসলা' যে পরিবর্তন করা, ত্রিপুরার বিভিন্ন জুম এলাকা থেকে সংগৃহীত সব্জী বীজের মান উন্নত করা অধিক উৎপাদনশীল নতুন জাত বিকাশ করা, উন্নত প্রথায় চাষবাসের প্রথা প্রচলন করা এক কথায় জুমিয়াদের কম সময়ের মধ্যে উচ্চ ফসলনশীল সব্জী উৎপাদন করে আর্থিক এবং সার্বিক উন্নতির জন্য এক কার্যকরী কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে।
বীজ শোধন:
বপনের আগে ফসলের বীজ ভালভাবে রৌদ্রে শুকিয়ে নিতে হবে। বীজ শোধনের জন্য কার্বেনডাজিম 50% গুড়ো ১ গ্রাম প্রতি ১ কেজি বীজে ভালোভাবে নেড়ে চেড়ে মিশিয়ে নিতে হবে (এক দেশলাই বাক্স পরিমাণ ঔষধ প্রতি ১০ কেজি বীজ)।
মাটি শোধন:
সাধারণতঃ জুমিয়ারা মাটি শোধন করেন না। জঙ্গল পোড়ানোতে মাটি শোধন ও পোড়ানো ছাই ফসলের সারের অভাব মেটাবার কাজ করে।
বীজ বপন:
সাধারণতঃ প্রাক মৌসুমী বৃষ্টির সুযেচাগ নিয়ে বৈশাখ মাসের প্রথম পক্ষের মধ্যে মিশ্র ফসল হিসেবে জুম সব্জী বীজ বপন করা হয়। নাগীছড়ার এইচ.আর.সির বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে জুম সব্জী ভাদ্র আশ্বিন মাসেও 'দো ফসলা' সব্জী হিসেবে উল্লেখযোগ্য উৎপাদনশীলতার প্রমাণ রেখেছে।
বীজ রোপনের দূরত্ব:
মিশ্র ফসলের 3-4টি জুম বীজ টাক্কাল ইত্যাদি দ্বারা 20-25 সেমি অন্তর অন্তর 5-10 সেমি গর্ত খুঁড়ে বপন করা হয়। একক ফসল হিসেবে খাকলু, কুমড়ার বীজ 2%-3 মিঃ দূরত্বে, সারি থেকে সারি 4m এবং 5-10 সেমি গর্ত করে বপন করা হয়। একক ফসল হিসেবে জুম লঙ্কা 1mx1m দূরত্বে লাগানো হয়।
সার প্রয়োগ:
বীজ বপনের পর N:P:K 15:15:16 (সুফলা, অমৃত) প্রতি চারটি বীজের বা চারার মাঝখানে টাক্কাল দিয়ে 3-4 সেমি গর্ত করে প্রায় ১ চা-চামচের পরিমাণ মতো প্রয়োগ করতে হবে। যেহেতু জুমিয়াদের রাসায়নিক সারের প্রতি অনীহা থাকে তার পরিবর্তে বায়োফার্টিলাইজার যেমন এজ্যোটোব্যাকটর, রাইজোবিয়াম ইত্যাদি প্রয়োগ করতে পারেন। বীজ বপনের 4-5 দিন আগে 2 ঝুড়ি গোবর সারের (20 kg) সাথে 250 গ্রাম বায়োফার্টিলাইজার মিশিয়ে হাল্কা জল ছিটা দিয়ে ছায়ায় রেখে দিতে হবে। বীজ শোধন করে বীজ বপনের সময় ভালোভাবে বীজের গায়ে ঐ জীবাণুসার (বায়োফার্টিলাইজার) লাগিয়ে বীজ বপন করতে হবে।
আগাছা নিয়ন্ত্রণ:
জুমের শষ্য বপনের তিন সপ্তাহের মধ্যে আগাছা গজিয়ে যায়। তাই প্রয়োজন অনুসারে বা প্রতি মাসে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় এবং ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক মাসে আগাছা নিয়ন্ত্রণ, চারা বাছাই শূন্যস্থানে চারা রোপন ইত্যাদি করা হয়।
রোগ পোকার আক্রমণ ও প্রতিকার:
সাধারণতঃ জুম সব্জীর জাত উচ্চ রোগ সহনশীল হয়। যদি সঠিকভাবে বীজ শোধন করা হয় তবে বীজ ঘটিত, ছত্রাকঘটিত রোগের আক্রমণ শতকরা ৮০-৯০ ভাগ কমে যায়। এছাড়া রোগের অন্যতম বাহক হলো বিভিন্ন ধরণের পোকার আক্রমণ। প্রত্যক্ষ ক্ষতি করে গাছ বা ফলের রস শুষে, কান্ড কেটে, শিকড় কেটে বা ফল / সব্জীর ভেতরের রসালো / শাসালো অংশ খেয়ে। প্রয়োজনবোধে বীজে বা পাতায় যদি বাদামী জল ছাপ দাগ, পাতা ঝলসা ইত্যাদি ছত্রাক বাহিত রোগ থাকে তবে Mancozeb, Diethere-M-45 B.M (0.5%) প্রতি ১৫ দিন অন্তর 2-2.5 ml /L জলে গুলে 2-3 বার স্প্রে করা উচিত। যেহেতু জুমিয়ারা রাসায়নিক সার বা ঔষধ ব্যবহারের প্রতি অনীহা প্রকাশ তাই রোগ সৃষ্টিকারী পোকার আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে মাঠে আলোক ফাঁদ দিয়ে, সন্ধ্যেবেলা ধোঁয়া দিয়ে, প্রয়োজনবোধে কেরোসিন মিশ্রিত জল স্প্রে করে বা Pherohormore দিয়ে। গাছে রোগের প্রথমাবস্থায় যদি গাছ তুলে পুড়িয়ে দেওয়া হয় তবে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা কম হয়। এছাড়া তামাক পাতা, নিমপাতা মিশ্রিত জল, গোমূত্র মিশ্রিত নিমপাতার জল স্প্রে করলেও ভাল ফল পাওয়া যায়।
ফসল তোলা:
বীজ বপনের ১০০-১২০ দিন পরে থেকেই মিষ্টি কুমড়া, খাকলু ফসল হিসেবে সংগ্রহ করা যায়। জুম লঙ্কা মোটামুটি ১২০ দিন থেকে সারা বছর ব্যাপী সংগ্রহ করা যায়।
বীজ সংগ্রহ:
আগামী দিনের জন্য রোগমুক্ত, পুষ্ট, উচ্চফলনশীল জাতের বীজ সংগ্রহ করা উচিত। ফসল তোলার পর বীজ ভালোভাবে রৌদ্রে শুকিয়ে পরিষ্কার ও খোলামেলা ঘরে বা গোলাজাত করা উচিৎ এবং প্রতি ১৫ দিন অন্তর নেড়ে চেড়ে দেওয়া দরকার। পোকামাকড় বা স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ার প্রাদুর্ভাব হলে কড়া রৌদ্রে বীজ শুকিয়ে নিতে হবে। এছাড়া সংগৃহীত বীজ ডোলে বা গোলায় রাখার সময় ছায়ায় শুকনো নিমপাতা বা শুকনা লঙ্কা মিশিয়ে রাখলে পোকা লাগা থেকে প্রায় 5-6 মাস বাঁচানো যায়।
মিশ্র ফসলের জুম চাষে সারা বছর ধরে জুমিয়াদের খাদ্য এবং অর্থের চাহিদাপূরণ করে। তবে বর্তমানে জুমিয়া ভাইদের জুমচাষের কুফল যেমন বনায়ণ ধ্বংস, বন্যা, খরা ইত্যাদির কারণ বোঝানো দরকার। যৌথভাবে উচ্চফলনশীল জাতের চাষ, সার প্রয়োগ, রোগ-পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সুসংহত ব্যবস্থাপনা, ফসল ও বীজ বাজারজাতকরণ, মজুতকরণ ইত্যাদি ব্যবস্থাপনার গ্রহণ করা দরকার যাতে জুমিয়ারা নিজেদের তথা সমাজের আর্থিক ও সার্বিক উন্নতি করতে পারেন।
0 মন্তব্যসমূহ