Advertisement

Responsive Advertisement

মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার সংবাদপত্রের ভূমিকা, পর্ব - ১

"মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার সংবাদপত্রের ভূমিকা" এটি মূলত এক মলাটের বই, কিন্তু পাঠকদের সুবিধার জন্য আমরা পর্ব আকারে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করছি - সম্পাদক 


                                  ড. আবুল আজাদ

                         ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের মুক্তিকামী জনতার কাছে ত্রিপুরা ছিলো তুলনামূলকভাবে নিরাপদ এক নির্ভরশীল আশ্রয়স্থল। এর বহুবিধ কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, যাতায়াতের সুবিধা আর ভাষা-সংস্কৃতির নৈকট্য। তাই সিলেট, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের দুর্জেয় পাহাড়ী সীমান্তের ভারতীয় অংশের গারো-অসমীয়া-ত্রিপুরী ও মিজো- নাগাদের ভিন্ সংস্কৃতির পরিবেশের চেয়ে বাংলাদেশের মানচিত্রের পেটের মধ্যে ঢুকে থাকা ত্রিপুরার বাঙালি অধ্যুষিত আগরতলাকে শরণার্থীরা সেদিন নিরাপদ মনে করেছে বেশি। লক্ষ লক্ষ মানুষ সেদিন পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ত্রিপুরার সরকার এবং জনগণও অসহায় উদ্বাস্তু-শরণার্থীদের গভীর মমতার সঙ্গে গ্রহণ করেন।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার এই ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা সর্বজনবিদিত। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তথা পশ্চিমবঙ্গ এ প্রসঙ্গে এ যাবৎ যতটা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে, ত্রিপুরা তার সিকিভাগ গুরুত্বও পায়নি। বর্তমান প্রজন্ম এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কথা, ২০ লক্ষ উদ্বাস্তু-স্বজাতি পূর্বপুরুষ কি করে প্রাণে বেঁচে মুক্ত- স্বাধীন দেশে বিজয়ীর বেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলো, সে সম্পর্কে খুব একটা কিছু জানেনা। কারণ সভ্যতা, সম্পদ ও শক্তি সবই পশ্চিমে। তাই পূর্বের ত্রিপুরা এখন আর আমাদের আকর্ষণ করে না। এর দায় ত্রিপুরার নয়, আমাদেরই। আমরা ইতিহাসের আলোক মালার যথাযথ প্রজ্জ্বলনে ক্লান্ত, ক্ষেত্র বিশেষে বিভ্রান্তও। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একদিন এই ত্রিপুরাই হয়ে উঠেছিলো জননী-জায়ারূপী এক সর্বসহা জনপদ। শরণার্থীর চাপ, মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ, ভারতীয় বাহিনীর সমাবেশ আর পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের গোলার আঘাত সবই সয়েছে ত্রিপুরা, আজ সয়ে যাচ্ছে আমাদের উপেক্ষাও।
ত্রিপুরার সর্বস্তরের মানুষ, সরকারি-বেসরকারি সবাই সেদিন জাতীয় দায় এবং মানবিক কর্তব্য মনে করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সহযোগিতা করা। রাজনীতিক, আমলা, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, ছাত্রসহ সকল পেশাজীবী মহল সর্বস্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে। এই পরিস্থিতি সূচনায় একাত্তরে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ত্রিপুরার সংবাদপত্রগুলো। শুধু তাই নয়, দেশি-বিদেশি সংবাদ মাধ্যমগুলোর কাছেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রধান তথ্যসূত্র হয়ে উঠেছিলো সেদিন ত্রিপুরার স্থানীয় পত্র-পত্রিকাগুলো।
৩৩ বছর আগের কথা। সভ্যতা ও প্রগতির সকল সুবিধাগুলো আমাদের এ অঞ্চলে তখন পর্যন্ত এসে পৌঁছেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শোষণ-বঞ্চনা ছিলো এর গ্রন্থের আলোচ্য সূচিকে তথ্য-উপাত্ত সংশ্লেষ পূর্বক মোট ৭টি শিরোনামে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে একাত্তরে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অসহায় সংবাদপত্র অধ্যায়টি। এতে ২৬ মার্চ থেকে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সংবাদপত্র দলনে হানাদার পাকবাহিনী কর্তৃক প্রেস সেন্সরশীপ আরোপ এবং বিচিত্র সব প্রেস এডভাইজ জারির নানা বিবরণ রয়েছে। ত্রিপুরার কাগজে প্রকাশিত মুক্তিকামী বাংলাদেশের মিডিয়া ও পত্রিকার এই করুণ অবস্থার বিবরণ উদ্ধৃত করে এই অধ্যায়টিকে যথাসম্ভব তথ্যনিষ্ঠ করা হয়েছে।

একাত্তরে ত্রিপুরার সংবাদপত্র অধ্যায়ে ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য ১১টি পত্রিকার নামের তালিকা উপস্থাপন করা হয়েছে। একই ভাবে একাত্তরে বাংলাদেশের প্রধান কারণ। একই ভাবে ভারতের ত্রিপুরাও তখন ব্যাপক উন্নতির কোন স্পর্শ লাভ করেনি তার ভৌগোলিক পশ্চাৎপদতার জন্য। তাসত্ত্বেও বাংলাদেশ এবং ত্রিপুরার মানুষ সেদিন একই ভাষা-সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধের তাগিদে পরস্পরের প্রতি সহমর্মী- পরমাত্মীয় হয়ে উঠেছিলো। কক্করক ভাষী ত্রিপুরার আদিবাসী ত্রিপুরী, রিয়াং, জমাতিয়া, নোয়াতিয়া, কলই, রূপিনী, মুরাসিং, উচই প্রভৃতি সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীও সেদিন ত্রিপুরার বাঙালিদের মতো বাংলাদেশের শরণার্থীদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে নয় মাসের জন্য হলেও বিভেদ, কুসংস্কার আর জাতি-উপজাতি-আদিজাতি ভেদাভেদের উর্ধ্বে স্থান দিতে পেরেছিলো। একাত্তরে আগরতলাসহ ত্রিপুরার স্থানীয় পত্র-পত্রিকাগুলোতে সীমান্তের দুই প্রান্তের একই ভাষা সংস্কৃতিধারী উভয় জনগোষ্ঠীর নানা মানবিক ও প্রতিরোধ তৎপরতার এই বিবরণগুলো সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেশী দেশের পাক হানাদারদের নির্মমতার প্রতিবাদ জানাতে অতিষ্ঠ করে তুলেছে নিজ দেশ তথা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে। কিন্তু এই ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর তথ্যসমূহকে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমরা চরম দৈন্যতার পরিচয় দিয়েছি। বিশেষ করে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ভূমিকা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমাদের ঔদাসীন্য সৌজন্যের সকল সীমা অতিক্রম করেছে।

এ বিষয় নিয়ে যে কিছু কাজ হয়নি, তা নয়-হয়েছে। সাংবাদিক হারুন হাবীব লিখেছেন-ডেটলাইন আগরতলা, ফজলুল বারীর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা এবং আগরতলা থেকে কল্যাণব্রত চক্রবর্তীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে এপারে একাত্তর। এসব গ্রন্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কমবেশি সংবাদপত্রগুলোর কথা এসেছে। দৈনিক সংবাদ, জাগরণ, গণরাজ, সাপ্তাহিক সমাচার, দেশের কথা ইত্যাদি কাগজের কথা বিষয়ানুযায়ী উল্লেখিত হলেও পরিসরের সীমাবদ্ধতার কারণে বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ ঘটেনি। বর্তমান গ্রন্থেও মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ভূমিকাটি পর্যালোচিত হয়েছে সীমিত পরিসরে। ব্যক্তিগত উদ্যোগই এর অন্যতম কারণ। গবেষণা পর্যায়ের তথ্য-উপাত্ত নির্বাচনে আকর উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে একাত্তরে ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোর মূল ফাইল। কাজেই তথ্যনিষ্ঠতা সম্পর্কে এক্ষেত্রে সন্দেহের খুব একটা অবকাশ নেই বলেই ধারণা করছি। 
মুক্তিবাহিনী ও বুদ্ধিজীবীগণ কর্তৃক ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র অধ্যায়ে রয়েছে ৬টি উল্লেখযোগ্য পত্রিকার তথ্য। একাত্তরে ত্রিপুরার সংবাদপত্রের বৈশিষ্ট্য অধ্যায়ে ত্রিপুরার এসব পত্রিকার সংবাদ-প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় কলামের বৈশিষ্ট্য সমূহ অত্যন্ত সংক্ষেপে বিভিন্ন উপ অধ্যায়ে বিশ্লেষণসহ দৈনিক সংবাদ, দৈনিক জাগরণ, দৈনিক গণরাজ, দৈনিক রুদ্রবীণা, সাপ্তাহিক সমাচার, সাপ্তাহিক দেশের কথা, অর্ধ সাপ্তাহিক জয়বাংলা, বাংলাদেশ, বাংলার মুখ, সাপ্তাহিক স্বাধীনতা ও একুশে ফেব্রুয়ারী শীর্ষক ১১টি পত্রিকার বৈশিষ্ট্য ও ভূমিকা পৃথক পৃথক ভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ত্রিপুরার সংবাদপত্রে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ত্রিপুরা ও ভারতের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের ভূমিকা শীর্ষক অধ্যায়ে ত্রিপুরা ও ভারত সরকারের উল্লেখযোগ্য এবং প্রতিনিধিত্বশীল প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সমাজসেবী, শিল্পী, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক ও রাজনৈতিক সংগঠনের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। ত্রিপুরার যেসব প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন মুক্তিযুদ্ধ ও শরণার্থীদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিলেন তাদেরও তালিকা এই পর্বে সংযুক্ত হয়েছে। একই ভাবে ত্রাণ কাজে সহায়তার জন্য সে সময় ত্রিপুরার স্থানীয় ও উদ্বাস্তুগণ বহু সংখ্যক সংস্থা-প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন, সারা ভারত থেকে বিভিন্ন সংগঠন শরণার্থীদের সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছিলেন ত্রিপুরায়। এদেরও একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা পাওয়া যাবে এই অধ্যায়ে। এই অধ্যায়টি একাত্তরে ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র সূত্রে প্রণীত হয়েছে। তবে এখানে উল্লেখ করা অপরিহার্য মনে করছি যে, এসব পত্রিকার সবকটি সংখ্যা যেমন আমার পক্ষে দেখা সম্ভব হয়নি, তেমনি একাত্তরে ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত সবকটি পত্রিকাও দেখার সুযোগ করে উঠতে পারিনি। তা সম্ভব হলে হয়তো এই তালিকা আরো দীর্ঘ হতো।
ত্রিপুরায় মুক্তিবাহিনীর সামরিক প্রশিক্ষণ ও মুজিবনগর সরকারের বেসামরিক প্রশাসনের তথ্যাদি অধ্যায়টি প্রণীত হয়েছে ত্রিপুরার সংবাদপত্রের পরোক্ষ সূত্র এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে জড়িতদের স্মৃতিচারণ সূত্রে। ইয়থ ট্রেনিং কনট্রোল বোর্ডের পরিচালক ও প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী অধ্যাপক দেবব্রত দত্তগুপ্তের মুক্তিযুদ্ধে যুব প্রশিক্ষণের পটভূমি শীর্ষক প্রবন্ধটি এই অধ্যায় নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিএলএফ মাউন্টেন ডিভিশনের নর্থ কলাম কমান্ডার দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার নাজমুল হাসান পাখী কর্তৃক সরবরাহকৃত তথ্যাদিও এই অধ্যায়টিকে পূর্ণতা দিয়েছে। এই অধ্যায়ে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারে অভ্যর্থনা কেন্দ্র, ইয়থ ট্রেনিং ক্যাম্প ও ভিত্তিফৌজের কার্যক্রম বর্ণনার পাশাপাশি এসব কার্যক্রম সংগঠনে দায়িত্ব পালনকারীদের নামের তালিকা, ৩১টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নাম ও স্থানের বর্ণনা, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর ব্যবহৃত ছদ্মনাম ব্যবহারের কারণ ও তালিকা, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ভিত্তিফৌজের সংখ্যা এবং যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশের সামরিক কর্মকর্তাদের নামের তালিকা প্রণীত হয়েছে।
পরিশিষ্টের উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ও ত্রিপুরা: একাত্তরের দিনপঞ্জী। ত্রিপুরার সংবাদপত্র সূত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের নানা কর্মকান্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িতদের স্মৃতিচারণ এবং এ সংক্রান্ত ঢাকা ও আগরতলার প্রকাশনাগুলোর সহযোগিতায় একাত্তরে ত্রিপুরায় সংগঠিত বা সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ৯৩টি উল্লেখযোগ্য ঘটনার বছরব্যাপী দিনপঞ্জী রয়েছে এই অধ্যায়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: ত্রিপুরার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর স্মৃতিচারণ পর্বে প্রয়াত কংগ্রেস নেতা শচীন্দ্রলাল সিংহ খোলামেলা ভাবে তাঁর অনুভূতি বর্ণনার পাশাপাশি ত্রিপুরা ও ভারতের সরকারি ও বেসরকারি নানা কর্মতৎপরতার বর্ণনা দিয়েছেন। অনেক অজানা তথ্য এই স্মৃতিচারণে উঠে আসায় ঐতিহাসিক প্রয়োজনে তা এখানে সংকলন করা হয়েছে।

এই অধ্যায়ের একটি উল্লেখযোগ্য পর্ব হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ: ত্রিপুরার চিঠি। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার নিজের আবেগ ও অনুভূতি। একাত্তরে ত্রিপুরার দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাংবাদিক বিকচ চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ ঘটে আমার আটানব্বইর আগস্টে আগরতলা সফরের সময়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আলোচনায় এই ভদ্রলোক আজও আবেগে বাকরুদ্ধ হয়ে ওঠেন। মুক্তিযুদ্ধের তথ্য খুঁজছি-এই সংবাদ পেয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এমনকি আগরতলায় আমার থাকা খাওয়ার সুবিধা অসুবিধারও খোঁজ করেছেন প্রায় প্রতিদিন। ফেরার আগের রাতে সার্কিট হাউজে এসে মুখবন্ধ খামে এই চিঠি এবং বাংলার মুখ পত্রিকার একটি কপি দিয়ে বললেন ঢাকায় ফিরে পড়তে। চিঠিটি অসম্ভব আবেগাশ্রিত ও ব্যক্তিগত সম্বোধনমূলক হলেও একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহে নিবেদিত ত্রিপুরার এক সাংবাদিকের মানবিক অনুভূতির পাশাপাশি নানা ঐতিহাসিক তথ্যে সমৃদ্ধ হওয়ায় ব্যক্তিগত সম্বোধন ও আবেগ অনুভূতিগুলো যথাসম্ভব পরিহার করে চিঠিটি এই গ্রন্থের পরিশিষ্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আগরতলার দৈনিক সংবাদ পত্রিকার কার্যনির্বাহী সম্পাদক পারমিতা লিভিংস্টোন গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে দৈনিক সংবাদের একাত্তরের ফাইল থেকে যাচিত সংখ্যাগুলোর ফটোকপি করে দিয়েছেন, স্বনামধন্য সাংবাদিক-সাপ্তাহিক সমাচার সম্পাদক অনিল ভট্টাচার্য তাঁর পত্রিকার দু'টি দুর্লভ সম্পাদকীয়র কাটিং সরবরাহ করেছেন, রমাপ্রসাদ দত্ত গবেষণাগারের স্বত্বাধিকারী রমাপ্রসাদ দত্ত একাত্তরে আগরতলা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদ, দৈনিক জাগরণ ও দৈনিক গণরাজ পত্রিকার দুর্লভ ক'টি সংখ্যা সরবরাহ করেছেন। ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের (একাত্তরে এটি ছিলো এমবিবি কলেজ) অধ্যাপক-কবি মিহির দেব মুক্তিযুদ্ধ উত্তর ত্রিপুরার প্রথম সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারীর দুর্লভ সংখ্যাটি সংগ্রহ করে দিয়েছেন। ঢাকার মুজিবনগর কর্মচারী কল্যাণ সংসদের চেয়ারম্যান এ লতিফ খান দৈনিক রুদ্রবীণার একটি দুর্লভ কপি সরবরাহ করে আমার এ কাজকে সমৃদ্ধ করেছেন। আমি এঁদের সকলের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে স্মরণ করছি বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেকুজ্জামান ফারুককে। যাঁর আন্তরিক সহযোগিতা আমার একাজকে অনেক খানি সহজ করেছে।

১২


মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার সংবাদপত্রের ভূমিকা শীর্ষক এই গবেষণা কাজের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধ উৎসব কেন্দ্রিক নানা কর্মকাণ্ড। গ্রন্থের মুখবন্ধে এই অনুপ্রেরণার পটভূমি বর্ণনার প্রবল তাগিদ অনুভব করছি। আমার ধারণা, গবেষণা কাজটি এতে পূর্ণাঙ্গতা পাবে এবং পাঠকের কাছে অনেক বিষয়ে বিচার-বিবেচনা সহজসাধ্য হবে।

বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন তার মুক্তিযুদ্ধ। উনিশ 'শ একাত্তরে এই যুদ্ধের সশস্ত্র পর্ব সংগঠিত হলেও বাঙালির জাতিসত্তার অঙ্কুরুদাম ঘটেছিলো হাজার বছর আগে, সেই চর্যাপদের যুগে-ভুষুপার কণ্ঠে। যে কবি প্রথম নিজেকে 'বাঙ্গাল' ঘোষণা করেন। একাত্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতিসত্তার চূড়ান্ত বিকাশ ঘটলেও যুদ্ধ কিন্তু শেষ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ কখনো শেষ হয়না। সশস্ত্র যুদ্ধে বিজয় তার ভূখণ্ডগত অধিকার এবং তাতে তার আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করে মাত্র। সেই স্বাধীন দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক সাম্য আর শিক্ষার সামগ্রিক অধিকার নিশ্চিত করার সংগ্রামই মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বিজয়ের পরবর্তী অধ্যায়।

বাঙালি জাতির স্বাধীনতার লড়াই জাতিসত্তা বিকাশের এই নিয়মতান্ত্রিক পথ ধরে অগ্রসর হতে পারেনি। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে জাতিসত্তা বিকাশের নিয়মতান্ত্রিকতায় অঙ্কুরেই ছেদ ঘটিয়েছে একাত্তরে পরাজিত শক্তির দোসর-দেশীয় রাজাকার-আলবদর ও মৌলবাদী ধর্মীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠী এবং তাদের আন্তর্জাতিক এজেন্টরা। কেবল বাঙালি জাতির স্থপতিকে হত্যা করেই সে দিন ক্ষ্যান্ত হয়নি এই কুচক্রী মহল। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা তাদেরই গড়া স্বাধীন দেশে নির্মমভাবে নিহত হন। নিহত হন মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও। জাতিপুত্রদের হত্যা ও নিপীড়নের এই ধারা পঁচাত্তর পরবর্তী সময় থেকে আজো অব্যাহত আছে। কি নির্মম আমাদের ইতিহাসের স্রোতধারা, এই সব প্রতিক্রিয়া-ক্ষীণ কালো-অন্ধকার অধ্যায়কে সে অবলীলায় বুকে ধারণ করে আছে।

বেদনাদায়ক অধ্যায় আরো আছে। একাত্তরে যে প্রতিবেশী রাষ্ট্র আমাদের সব কিছু দিয়ে সহযোগিতা করেছে। এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয়, খাদ্য, বাসস্থান ও চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে, মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে রণক্ষেত্রে পাঠিয়েছে-সেই ভারতের সঙ্গে আমরা সম্পর্ক সৎ ও সুন্দর রাখতে ব্যর্থ হয়েছি। একাত্তরে দুর্দিনের সেই বন্ধুরা ক্ষোভে-বেদনায় গুমড়ালেও মুখফুটে কিছু বলেন না। কারণ তার চেয়েও বড় বেদনা যে বাঙালির বুকে-জাতির মুক্তিসংগ্রামের স্থপতিকেই তো আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ভাবের কথাতো আসে পরে। এই অস্থিতিশীল সমাজ-ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গ-ত্রিপুরা-আসামের প্রায় বারো কোটি ভারতীয় বাঙালি আজো

১৩

বাংলাদেশের সুখে আনন্দিত, দুঃখ-বেদনায় ভারাক্রান্ত হন। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম বাঙালি জাতিসত্তার এই ভৌগোলিক নৃতাত্ত্বিক চিরায়ত ঐতিহ্য সম্পর্কে ওয়াকিফহাল নয়!

স্বাধীনতার পর অনেক সময়তো পেরিয়ে গেলো, তেত্রিশ বছর-তিন যুগই বটে। কিন্তু একবারের জন্যেও আমরা একাত্তরের দুর্দিনের সেই ভারতীয় বন্ধুদের খবর জানতে চাইনি। আত্মীয়-বন্ধুর বাড়ীতেওতো বছরে একবার খোঁজ নেয়া হয়। কিন্তু জাতির মুক্তিসংগ্রামে যে ছিলো আমাদের পরমাত্মীয়, রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-বাদলে যে তার নিজের ঘর ছেড়ে দিয়ে আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলো-তার খোঁজ আমরা এত দীর্ঘ সময়েও নিতে পারেনি। জাতি এই ঐতিহাসিক লজ্জার ক্ষতকে আর কতকাল বহন করবে?

দুর্দিনের সেই বন্ধুদের কৃতজ্ঞতা জানাতে প্রথম প্রয়াস হিসেবে সাতানব্বইর ২-৪ ডিসেম্বর কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ট এণ্ড লিটারারী সোসাইটির সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধ চেতনার ইতিহাস ও সাহিত্য বিষয়ক সংগঠন রাইটার্স বাংলাদেশের উদ্যোগে প্রথম আমরা কলকাতায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধ উৎসবের আয়োজন করি। বাংলাদেশ থেকে একাত্তর সদস্যের একটি মুক্তিযোদ্ধা-সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলসহ পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ, সমাজকর্মী, রাজনীতিক, সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষ উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। যাদের অধিকাংশই একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নানা ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। কয়েক হাজার দর্শক-শ্রোতা উৎসবের মূল অনুষ্ঠানে তন্ময় হয়েছিলেন। উৎসবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য ১৭ জন সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিশিষ্ট ভারতীয় নাগরিককে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এই প্রতীকী সংবর্ধনার মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য প্রথম ভারতীয় জনগণকে সম্মান ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে পেরেছি। এটি ছিলো এ ধরনের প্রথম উদ্যোগ। দেশি-বিদেশী বার্তা সংস্থা ও প্রচার মাধ্যমে উদ্যোগটি বহুল প্রশংসিত হয়।
এরপর আমরা মুক্তিযুদ্ধ উৎসব ত্রিপুরা আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করি এবং এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার জন্য ত্রিপুরা সরকারের তথ্য, সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রী শ্রীজীতেন্দ্র চৌধুরীর আমন্ত্রণে উৎসবের উদ্যোক্তা সংগঠন রাইটার্সের পক্ষ থেকে আটানব্বইর ১৪-২১ আগষ্ট বর্তমান গ্রন্থকার ত্রিপুরা সফর করেন।

উৎসব আয়োজনের আগে এই সফরটির অপরিহার্যতা যে ছিলো বিস্তর, তা উপলব্ধি করা যায় ত্রিপুরা গিয়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘ ২৭ বছর আগের ঘটনা। কিন্তু প্রতিটি ত্রিপুরাবাসীর অন্তরে অতন্দ্র প্রহরীর মতো আজো জাগরুক হয়ে আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। এদের অনেকে প্রশ্নও করলেন মুক্তিযুদ্ধ উৎসব ত্রিপুরার আগে কলকাতায় হলো কেন? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেতো ত্রিপুরাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রশ্নকর্তাদের এই মনোভাবে যথেষ্ট যুক্তি আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা ছিলো সামরিক দিক থেকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় ভূখণ্ড। অনেকে তাই ত্রিপুরাকে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সামরিক রাজধানী বিবেচনা করেন। এই বিবেচনা সর্বদিক দিয়েই যুক্তিসংগত।

১৪

এই সফরকালে ত্রিপুরার রাজনীতিক, সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, আলোকচিত্রী ও সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সমাজের প্রায় সর্বস্তরের বিভিন্ন পেশার নাগরিকদের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কথা বলেছি। যুদ্ধ পরবর্তী উভয় দেশ সম্পর্কেও জানতে চেয়েছি। আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কুটনীতির হালচাল সম্পর্কে নৃত্যতম জ্ঞান রাখেন-এ ধরনের সজ্জন ত্রিপুরাবাসী এই প্রশ্নের উত্তরে নির্লিপ্ত ছিলেন। একেবারেই যাঁরা সাধারণ নাগরিক-তাঁরা কোন বাছ বিচার করে কথা বলেননি। তাদের বক্তব্য একটাই, দেশটাতো বাংলাদেশ। ভৌগোলিক দিক থেকে তার পেটের মধ্যে ঢুকে আছি আমরা। ভাষা-সংস্কৃতিও প্রায় একই রকম এবং আমাদের অনেকেরই পিতৃভূমিও বাংলাদেশ। তাই দুই দেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ট হলে ভালো। দুই দেশের মধ্যে যাতায়াত আরো সহজ করা উচিৎ।
মূল ভারতের সঙ্গে ত্রিপুরার স্বাভাবিক সম্পর্ক আকাশ পথে। মেঘালয়-আসামের পর্বত-নদী-অরণ্য পেরিয়ে ২/৩ দিনে সড়ক পথে হয়তো ত্রিপুরা থেকে পশ্চিমবঙ্গ পৌঁছানো যায়। কিন্তু রাজধানী দিল্লী যেতে সময় লাগে কমপক্ষে আরো ২দিন। তাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী এই ত্রিপুরাবাসীর প্রত্যাশা ছিলো বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এই বন্ধু দেশের ভেতর দিয়েই চলাচলের বৈধ সুযোগ তারা পাবে। খুব বড় মাপের প্রত্যাশা ছিলো কি এটা? কিন্তু সেটা তারা পায়নি, এমন কি চট্টগ্রামের ভেতর দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের আশাও করেছিল তারা-তাও হয়নি। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী মানিক সরকার আগরতলার পার্টি অফিসে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় এই আক্ষেপ প্রকাশে কোনো কার্পণ্য করেননি।
ত্রিপুরা সফরে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার ভূমিকা সংক্রান্ত দুর্লভ বেশ কিছু তথ্যাদি, আলোকচিত্র ও ডকুমেন্ট সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। সম্ভব হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহ পরিদর্শন। ত্রিপুরা সরকারের তথ্য-সংস্কৃতি ও পর্যটন দপ্তর এব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। বস্তুত গোটা ত্রিপুরার ৮০ ভাগ সীমান্ত অঞ্চলই বাংলাদেশ সংলগ্ন হওয়ায় এটা পৃথক করে দেখা খুবই দুঃসাধ্য যে ত্রিপুরার কোন অঞ্চলের ভূমিকা বেশি ছিলো। প্রাদেশিক রাজধানী আগরতলা হওয়ার কারণে আগরতলা শহরের ওপর চাপ বেশি ছিলো সত্যি। কিন্তু সমগ্র ত্রিপুরা জুড়েই একাত্তরে বিস্তৃত ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও শরণার্থী কার্যক্রম। বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর গভীর পাহাড়ী অরণ্যে ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রানজিট শিবির ও প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। তাই সমগ্র ত্রিপুরার বাংলা ভাষী-আদিবাসী সকল সম্প্রদায়ই সেদিন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ বাংলাদেশের শরণার্থীদের সহযোগিতা করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বাড়িয়ে দিয়ে ছিলেন সহযোগিতার হাত। ১৪ লক্ষ ত্রিপুরাবাসী সেদিন ১৫ থেকে ২০ লক্ষ বাংলাদেশী শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে বিশ্বের বুকে স্থাপন করেছেন মানবতার এক অনন্য নজীর। যুদ্ধের ২৭ বছর পর এসব খোঁজ খবর করতে যাওয়া বাস্তবিক এক ধরনের বিব্রতকর কাজ। বিশেষ করে যুদ্ধের পর যেখানে উভয় দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের পরিবর্তে অবনতির ধারাই

১৫

অব্যাহত ছিলো। তাই হোঁচট খেতে হয়েছে, মানুষ অবাক বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে আমাদের খুঁটিনাটি প্রশ্ন ও তৎপরতা গুলো। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে; ত্রিপুরার কোথায় নেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, তা চিহ্নিত করা বেশ দূরহ কাজ। যেখানে গোটা ত্রিপুরার ১৪ লক্ষ মানুষই আমাদের মুক্তিসংগ্রামে কোন না কোন ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন সেখানে এ প্রশ্ন অবান্তরও। নতুন প্রজন্মের ত্রিপুরাবাসী আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পুরাতনদের মতো স্পর্শকাতর না হলেও পূর্বপুরুষদের কাছে শুনে বাংলাদেশ সম্পর্কে তারাও এক ধরনের মানসিক নৈকট্য বোধ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকা, সিলেটসহ বাংলাদেশের মাটি তাদের কাছে এক অপার বিস্ময়ের স্বপ্নরাজ্য।
তথ্যের সন্ধানে ত্রিপুরা সরকারের পর্যটন দপ্তরের সহযোগিতায় ঘুরেছি ত্রিপুরার বিভিন্ন অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে। এই সফরের গন্তব্য ছিলো আগরতলা থেকে মেলাঘর পথে বটতলা, ভট্টপুকুর, মিলনসংঘ, বরদোয়ালী, ড্রপগেট, পুলিশ রিজার্ভ, মিলন চক্র, ফকির ঘাট, সিদ্ধিআশ্রম, নিমবাগ আশ্রম, ওএনজিসি, হাপানিয়া, আমতলী, কুড়িপুকুর, চৌমুহনী বাজার, শেখের কোট, বিশালগড়, ২ নং গেট বিএসএফ ক্যাম্প, অফিস টিলা, চড়িলাম, বিশ্রামগঞ্জ, নলছড়, বৈরাগীবাজার। বিশ্রামগঞ্জ- সাব্রুম পথে বাঘমার, উদয়পুর, চন্দ্রপুর, গর্জি, বীরচন্দ্রমনু, বাইখোড়া, শান্তিবাজার, মনুপংকুল, সাব্রুম, হরিণা, সাচান। শান্তিবাজারের পর বাগাফা, পিলাক, রাজনগর, বিলোনিয়া, একিনপুর তারপর বাংলাদেশ সীমান্ত। উদয়পুর- অমরপুর পথে নতুনবাজার, কিল্লারক, যতনবাড়ি, ডুম্বুর, নন্দিরঘাট তারপর জলপথ। এই বিশাল অঞ্চলসহ সমগ্র ত্রিপুরার লক্ষ লক্ষ মানুষ আজো বেঁচে আছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে। তাঁদের এই অনুভূতিকে সম্মান জানানোর সময় দ্রুত অতিক্রান্ত হচ্ছে।

একাত্তরে ত্রিপুরার আপামর জনগোষ্ঠীকে এই ভূমিকায় উদ্বুদ্ধ করতে সেদিন মূল সংগঠকের ভূমিকা নিয়েছিলেন ত্রিপুরার তৎকালীন রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও ছাত্র নেতৃবৃন্দ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এদের অবদান বিশ্বে অনন্য, নজীর বিহীন। ত্রিপুরার এইসব মহানুভব জাতিবাদী নেতৃবৃন্দের নাম বাংলাদেশকে আজন্মকাল স্মরণ রাখতে হবে। ত্রিপুরার তৎকালীন কংগ্রেস নেতা ও মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ (প্রয়াত), তৎকালীন বিরোধী দলীয় বামপন্থী নেতা ও পরবর্তীতে মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তী, কংগ্রেস নেতা ও পরবর্তীতে মন্ত্রী দেবেন্দ্র কিশোর চৌধুরী, রসিকলাল রায়, তৎকালীন বিরোধী দলের (সিপিএম) সেক্রেটারী ভানু ঘোষ, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, শিক্ষামন্ত্রী ও তৎকালীন ছাত্রনেতা কবি অনিল সরকার, চীফ সেক্রেটারী আইপি গুপ্তা, আইজি অব পুলিশ বিজি কালিয়া, জেলা প্রশাসক বদ্রিনাথ, সোনামুড়ার এসডিও হিমাংশু চৌধুরী, দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সম্পাদক ভূপেন দত্ত ভৌমিক (প্রয়াত), সাংবাদিক ভীষ্মদেব ভট্টাচার্য (প্রয়াত), সাপ্তাহিক সমাচার পত্রিকার সম্পাদক অনিল ভট্টাচার্য, জজ এস এম আলী (প্রয়াত), সাংবাদিক বিকচ চৌধুরী, সত্যব্রত ভট্টাচার্য, (কল্যাণব্রত চক্রবর্তী),

১৬

খগেন দাশ এমপি, তাঁর স্ত্রী সিপিএম শিক্ষক-নেত্রী অনুপমা দাশ, ইণ্ডিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের তৎকালীন রাজ্য শাখার সম্পাদক ডা. দীপক মজুমদার, বন কর্মকর্তা নরেশ ভট্টাচার্য, তাঁর স্ত্রী আশালতা ভট্টাচার্য, এমবিবি কলেজের (বর্তমান ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক মিহির দেব, কলেজটিলা হোষ্টেল সুপার সত্যরঞ্জন ভট্টাচার্য (প্রয়াত), সিপিআই নেতা কানুসেন গুপ্ত, তাঁর ছোটভাই আলোকচিত্রী রবীন সেনগুপ্ত, বর্তমানে জয়নগরবাসী সরোজ চন্দ, শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. সুজিত দে, সার্জন ডা. রথীন দত্ত, ডা. এইচ এস রায় চৌধুরী, উপজাতি নেতা- বিধান সভার সাবেক অধ্যক্ষ সুধন্বা দেব বর্মন, লালমনি দেব বর্মন, করবী দেব বর্মন ও ত্রাণ দপ্তরের কর্মকর্তা পঞ্চমজিৎ সিংসহ আরো বহু বিশিষ্ট ত্রিপুরাবাসী একাত্তরে ত্রিপুরার শরণার্থী শিবিরে আমাদের জীবন ও মান বাঁচাতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন।
ত্রিপুরার সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজসহ ধর্মীয় উপাসনালয়ও সেদিন শরণার্থীদের সহযোগিতার প্রশ্নে মানবতার পরীক্ষায় অনন্য নজীর স্থাপন করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সহযোগিতা করার জন্য গঠিত হয়েছে নতুন নতুন সংস্থা- প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এ যাবৎ এসব প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরী হয়নি। স্বাধীনতার তিন দশক পর আজ যথাস্থানে সবকিছু গচ্ছিতও নেই। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে সবকিছু। ত্রিপুরা সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর গত ৩১বছরে বেশ কয়েকবার স্থান বদলের কারণে দুর্লভ তথ্যাদি ও উপকরণ সংরক্ষণের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে সন্দেহ নেই। তবে সম্পূর্ণরূপে হতাশ হওয়ার পরিস্থিতি এখনও আসেনি। নিরবে-নিভৃতে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাঙালি সংস্কৃতির অন্তপ্রাণ কিছু ব্যক্তি এ সম্পর্কে কাজ করে যাচ্ছেন। ত্রিপুরা সরকারের তথ্য-প্রচার দপ্তর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ কিছু আলোকচিত্রের একটি এলবাম প্রকাশ করেছে। সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যের এ সংক্রান্ত বেশকিছু লেখা ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ও ভারতে প্রকাশিত হয়েছে। স্বতন্ত্র বই বেরিয়েছে ৩টি। যার কথা আগেই উল্লেখ করেছি।

মুক্তিযুদ্ধ উৎসব ত্রিপুরা আয়োজনের প্রস্তুতি সম্পাদনার্থে ত্রিপুরা সফরে গিয়ে এই সব বহুবিধ বিচিত্র অভিজ্ঞতা আর সংগৃহীত তথ্যাবলীর সার সংকলনই বর্তমান গ্রন্থটি। জাতির মুক্তি সংগ্রামের এক আলোচিত অধ্যায় হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার সংবাদপত্রের ভূমিকা পাঠক তথা নতুন প্রজন্মকে সমৃদ্ধ করলে আমার শ্রম সার্থক হবে।

এই গ্রন্থের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের ক্ষেত্রে ত্রিপুরার যুব-ক্রীড়া ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শ্রী জীতেন্দ্র চৌধুরীর ভূমিকা অসামান্য। তাঁর সহযোগিতা না পেলে প্রকৃত অর্থে আমার পক্ষে এই কাজটি করা সম্ভব হতো না। গভীর যত্ন, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি তাঁর মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে আমার কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতার নির্দেশ

১৭

দেন। আমি এ জন্য মান্যবর মন্ত্রীমহদয়কে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আগরতলার বাংলাদেশ ভিসা অফিসের প্রথম সচিব জনাব আবদুল্লাহ মিয়ার আন্তরিক সহানুভূতির কথাও এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। ত্রিপুরা সরকারের পর্যটন দপ্তরের কর্মকর্তা শ্যামল ভট্টাচার্য ও রাইটার্সের শুভেচ্ছা দূত ভারতী স্যানালের সার্বিক সহযোগিতা আগরতলায় আমার কাজকে অনেকখানি স্বচ্ছন্দ করেছে। আর অগ্রজ অনিল দা (সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য) ও গৌরী বৌদির কথা আরো একবার এখানে স্মরণ করছি। আতিথ্য ও স্নেহ দিয়ে এই দম্পতি আমার শ্রদ্ধেয় হয়েছেন।
এখানে আরো একটি তথ্যের উল্লেখ না করলেই নয়। যে মুক্তিযুদ্ধ উৎসব ত্রিপুরা আয়োজনের জন্য আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম এবং তার প্রস্তুতি সম্পাদনার্থে ছিলো এই সফর, শেষ পর্যন্ত ঐ উৎসব আর বাস্তবায়িত হয়নি। প্রথমে আমরা উৎসব বাস্তবায়নের জন্য ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা চেয়েছিলাম। ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়টি ত্রিপুরা সরকারে সমর্পন করে। ত্রিপুরা সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী হলেও, এমনকি উৎসব সংক্রান্ত কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য কর্মসূচি প্রণয়নের পাশাপাশি ঢাকা ও ত্রিপুরায় সভা- সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হলেও শেষ পর্যন্ত ত্রিপুরা কর্তৃপক্ষ আমাদের এই উদ্যোগে নিরবতা অবলম্বন করেন এবং নিজেদের মতো করে রাজনৈতিক মিত্রদের দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ উৎসব আগরতলা আয়োজন করেন। উৎসবে মুক্তিযুদ্ধের স্থপতি-বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনের বিরোধিতা করে উদ্যোক্তারা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গীর মানদণ্ড প্রকাশ করেন। ত্রিপুরার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিশিষ্ট নাগরিক এ সম্পর্কে আমাদের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। দুর্ভাগ্য আমাদের, একই রাজনৈতিক দর্শনের সরকার পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ উৎসব কলকাতা আয়োজনে সেখানে আমাদের এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে হয়নি।
ইতোমধ্যে গত ৯ ডিসেম্বর ২০০০ এ আমরা ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ উৎসব আসাম আয়োজন করি এবং এ যাত্রায়ও একাত্তরে আসাম থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকার কিছু কপি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধে আসামের সংবাদপত্রের ভূমিকা শীর্ষক অনুরূপ আরেকটি কাজ করার প্রত্যাশা নিয়ে শেষ করছি।

ড. আবুল আজাদ,

২১ শে ফেব্রুয়ারি ২০০৪ 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সাভার, ঢাকা


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ