(সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, গন্ডাছড়া সরকারি মহাবিদ্যালয়, ধলাই , ত্রিপুরা)
রহস্যময়ী ত্রিপুরা তার রহস্যময়ী প্রকৃতি ও অদ্ভুত মিশ্র সংস্কৃতির আরেক নিদর্শন রাজরাজেশ্বরী দেবী I আমরা ত্রিপুরেশ্বরী মায়ের কথা বা কমলেশ্বরী মায়ের কথা অনেকবার শুনেছি; আবার ছবিমুড়া বা দেবতামুরায় দশভূজা কেও অনেকবার দেখেছি। কিন্তু আমাদের এই ছোট্ট রাজ্যে তথা ভারতবর্ষের এই পূণ্যভূমিতে মায়ের আরেক রূপ অধিষ্ঠান করছেন; তিনি অষ্টাদশ ভুজা রাজরাজেশ্বরী দেবী I অথচ হয়তো প্রচারের ইনি জনমানষে সেভাবে পরিচিত হয়ে উঠতে পারেননি I কিংবা দেবী নিজেই জনসমক্ষে আসতে রাজি হননি, আত্মগোপন করে আছেন I আমি যতটুকু দেখেছি আমার এই বয়স পর্যন্ত, তাতে কোনদিন আমি অষ্টাদশভুজা দুর্গার রূপ দেখিনি I কষ্টিপাথরের এই মূর্তির সাথে কোথাও যেন আমার ছবিমুড়ার দুর্গার আকৃতি ও রুপগত মিল আছে বলে মনে হয়েছে I সৌভাগ্যক্রমে মুহুরিপুর যাওয়ার সুবাদে, এই রাজরাজেশ্বরী কে দর্শন করতে পেরেছি I সেখানে গিয়ে জানতে পেরেছি অষ্টম শতকের অন্যতম স্থাপত্য ও ও শিল্পের অমূল্য ঐতিহ্য বহন করছেন রাজরাজেশ্বরী দেবী I স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে আনুমানিক ১৯৩১ সালে ব্রহ্মচারী হরানন্দগিরি মহারাজ ব্রহ্মদেশ থেকে ফিরে এসে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন I সেই সময়ে অনাবিস্কৃত পিলাক অঞ্চল থেকে তিনি চারটি মূর্তি মন্দিরের স্থাপন করেন ; যার মধ্যে রয়েছেন সূর্য, মঙ্গল চন্ডী, গণেশ ও রাজরাজেশ্বরী বা দুর্গা I ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের ধারণা এই মূর্তিগুলি হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির মিশ্রণের এক অদ্ভুত নিদর্শনের ঐতিহ্য বহন করছে I তথ্য অনুযায়ী অষ্টাদশভুজা দেবীর এই রূপ হল দেবী দুর্গার আরেক রূপ কাত্তায়নী, যা দেবীর ষষ্ঠ রূপ বলে জানা যায় I এই অঞ্চলে ইনি রাজরাজেশ্বরী নামে প্রচারিত। এটি দেবীর একটি বিরলতম রূপ Iলোকশ্রুতি আছে যে হরানন্দগিরি মহারাজ সহস্রাধিক কেজি ওজনের এই বিগ্রহগুলি নাকি একাই পিলাক অঞ্চল থেকে একটি ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে এসেছিলেন I কিন্তু পরবর্তীতে এই মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় বিগ্রহগুলিকে নতুন মন্দিরে প্রতিস্থাপন করার জন্য ক্রেনের মত আধুনিক যন্ত্র প্রয়োগ করেও আনা কঠিন হয়ে গেছিল I রাজরাজেশ্বরী দেবীর মূর্তির সাথে কষ্টিপাথরের সূর্য, মঙ্গল চন্ডী, ও গণেশের বিগ্রহও এই মন্দিরে বিরাজ করছেন। এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, এই সমস্ত বিগ্রহ গুলি আমাদের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বহন করছে। লোকশ্রুতি আছে ত্রিপুরার শেষ নৃপতি মহারাজা বীর বিক্রম মানিক্য বাহাদুর এই মন্দির ভ্রমণ কালে মন্দিরের তৎকালীন পুরোহিত ও প্রতিষ্ঠাতা ব্রহ্মচারী হরানন্দগিরি মহারাজকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য একটি ত্রিশূল দান করেছিলেন এবং বলাবাহুল্য মন্দিরে এখনো সেই ত্রিশূলটি বিরাজমান আছে। মহারাজার স্মৃতি বিজড়িত মন্দির বলে এই মন্দিরের নামকরণও রাজরাজেশ্বরী মন্দির হিসেবে রাখা হয়েছে বলে জানা যায় I প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, মহারাজা ওই অঞ্চল সফরকালে ওই এলাকার নাম 'লুঙ থুঙ' থেকে নাকি মুহুরিপুর নামে নামকরণ করে যান I সেই থেকেই এই মন্দির মুহুরিপুর গ্রামের রাজরাজেশ্বরী মন্দির নামেই জনসমক্ষে পরিচিত হয়ে ওঠে I হরানন্দগিরি মহারাজের মৃত্যুর পর তার যোগ্য শিষ্যা রাধারানী ভৈরবী মন্দিরের পূজা অর্চনার ধারা অব্যাহত রাখেন I ২০০৬-২০০৭ সালে এই মন্দির পুনরনির্মাণ করে বিগ্রহগুলিকে নতুন মন্দিরে স্থানান্তর করা হয়। নতুন আধুনিকতার ছোঁয়ার মাঝখানেও ঐতিহ্যবাহী এই বিগ্রহ গুলি উজ্জ্বল হয়ে আছে এবং সত্যই এই স্থান মনকে এক অসাধারণ প্রশান্তি দান করে I
0 মন্তব্যসমূহ