এই লেখাটি রাজ্যের বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী মানস পালের ফেসবুক থেকে উনার অনুমতির ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছে।
আমি শিল্প বোদ্ধা কেউ নই , এসব ব্যাপারে জ্ঞানগম্যি একেবারে সাধারণ। তবে, একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবেই বলি , ত্রিপুরার নতুন এমব্লেমটি আমার পছন্দ হয়নি। ঠিক যেমন পছন্দ হয়নি ত্রিপুরা ট্যুরিজমের লোগো -- কেন পছন্দ হয়নি ত্রিপুরা ট্যুরিজমের লোগো এ নিয়ে বেশ ক'বার লিখেছি। হয়ত অনেকে পড়েছেনও। ট্যুরিজমের লোগোতে সাংঘাতিক সব ভুল আছে --জাস্ট দুটো উদাহরণ দিচ্ছি। ত্রিপুরায় snow capped mountains নেই, alpine mountains নেই , কিন্তু লোগোতে দিয়ে রেখেছে ধর্মনগরের মাথার উপর দেবদারু গাছের সারি আর বরফ ঢাকা পর্বত -- লোকের কাছে বা অন্যভাবে বললে ট্যুরিস্টদের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে ,কে কাকে বোঝায় ?... একটা চশমা বাঁদর দেখবেন বসে আছে --তার ন্যাজ টা দেখুন হিসাব করলে ২০ হাত লম্বা। চশমা বাঁদর তো বহু দেখলাম তবে এতো লম্বা লেজের চশমা বাঁদর এই লোগোতেই দেখেছি। একদম উপরে আবার একটা ফ্ল্যাগ উড়িয়ে রেখেছিল এটা বোধহয় এখন আর নেই ...বাকি অত্যধিক রংচঙে ছবির ভেতর 'ফোকাল পয়েন্ট কোথাও নেই' --কোনো মেসেজ নেই. ত্রিপুরা ট্যুরিজমের লোগো একটি at best ইলাস্ট্রেশন বলা যেতে পারে , 'লোগো' নয়। লিখেছি অনেক, বলেছিও , কিন্তু অরণ্যে রোদন।
সে যাই হোক স্টেট্ এমব্লেমের কথায় আসি ....
এবার , ত্রিপুরার এই নতুন এমব্লেমটিও আমার কাছে একটি ম্যাড়ম্যাড়ে-- ইংরেজিতে যাকে বলে --'ব্ল্যান্ড' মনে হচ্ছে।
সাধারণতঃ কোন রাজ্যের এমব্লেম সে রাজ্যের নিজস্ব পরম্পরা , সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক , নৃতাত্বিক , স্থাপত্যশিল্প , পৌরাণিক চরিত্র, ফোক আর্ট , ট্রাইবাল আর্ট, নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদ , ফুল বা প্রাণী, আর্কিটেকচারাল আইকন এমনকি ধর্মীয় 'মোটিফ' বা এধরণের বিশেষ ইউনিক উপাদানকে শৈল্পিক এবং প্রতীকী হিসাবে উপস্থাপিত করে , যা হবে সর্বজনগ্রাহ্য এবং সর্বজনবোধ্য এবং অবশ্যই নান্দনিক । উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি , কর্ণাটকের এমব্লেমে দুটি পৌরাণিক সিংহ রয়েছে, যেখানে তামিলনাড়ুর প্রতীকে একটি মন্দির-- গোপুরম রয়েছে যা তাঁদের দ্রাবিড় স্থাপত্য ঐতিহ্যের প্রতীক। আবার কেরালার এমব্লেম- এ রয়েছে দুটি হাতি এবং একটি শঙ্খ , কেরালার সাংস্কৃতিক শিকড় এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতীক। অন্যদিকে পাঞ্জাব সমৃদ্ধি এবং শক্তির প্রতীক হিসেবে গমের ডাঁটা এবং সঙ্গে রয়েছে পাঞ্জাবিদের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত কৃপাণ যা তাঁদের শৌর্য -এর প্রতীক। ত্রিপুরার নতুন এমব্লেম-এ এসব কিছুই হয় নি। একটি সাধারণ গোল চক্কর, তার ভেতর ত্রিপুরার মানচিত্র , মানচিত্রের ভেতর অশোক স্তম্ভ - ব্যাস। একটার ভেতর একটা। গল্প শেষ। মানচিত্র তো তো সবাই জানবে , কিন্তু এই এমব্লেমে ত্রিপুরার কোন বিশেষ চরিত্রটি প্রকাশ পাচ্ছে ? কি এমন ইন্টারেষ্টিং বিষয় আছে যা দেখে একজন আকৃষ্ট হবে ? বা, দুবার তাকিয়ে দেখবে ? কি মেসেজ দিচ্ছে এই এমব্লেম ? আমি কিছুই দেখতে পাই নি। গেরুয়া রং দেখে অনেক রাজনীতির তার্কিকরা বলবেন -বিজেপি দেখে গেরুয়া লাগানো হয়েছে। আমি যদি এভাবে বিষয়টি না ও দেখি , তাহলেও শিল্পী না হয়েও এটা বলতে পারি ( পত্রিকা করি তো , প্রতিদিন ডিজাইন করতে হয় তাই) গেরুয়ার মধ্যে সাদা কখনোই ফুটে না। দুটোই হালকা রং। সিপিএমের লাল হলে --কি হত ? কি আর হত --ক্যাট ক্যাটে একটা ব্যাপার হত। ফলে রং পছন্দ করার ক্ষেত্রেও অল্প মাথা ঘামানো উচিত ছিল।
তবে , বেশি বেশি কিছুই ভালো না - মধ্যপ্রদশের এমব্লেম দেখবেন রং চং লাগিয়ে বিতিকিচ্ছি একটা ব্যাপার , আর পশ্চিম বঙ্গের এমব্লেম তো পাকামোর চূড়ান্ত -- এই দুটি রাজ্যের এমব্লেম একবারে যা খুশি। এদের কোন বিশেষ চরিত্রই নেই। শুধু পশ্চিমবঙ্গের এমব্লেম বাংলায় 'পশ্চিমবঙ্গ সরকার' লেখাটি আছে , ইংরাজীর সঙ্গে। পশ্চিম বঙ্গের এমব্লেম 'ব'- এর আইডিয়া আমার কেন জানি মনে হয় উষা ঊত্থুপের কপালের 'ক' থেকে ইন্সপায়ার্ড।
স্টেট্ এমব্লেম বা ডিপার্টমেন্টাল লোগো তৈরী করতে গেলে প্রফেশনালদের সাহায্য নেয়া উচিত , যাঁরা এবিষয়ে পড়াশোনা করেছেন , NID বা এধরণের প্রতিষ্ঠান থেকে এসব বিষয়ে পড়াশোনা করে পাশ করেছেন। এধরণের ডিজাইনিং-এ এক্সপার্টদের রাজ্য বা দপ্তরের ইতিহাস, সংস্কৃতি , ঐতিহ্য , জনবিন্যাস , প্রকৃতি , প্রকৃতির সম্পদ , পরম্পরা , লোকগাথা রাজ্যের নিজস্ব ভ্যালুজ বা চরিত্র ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে বিশদে অবহিত করেই তাঁদের কাছে থেকে এমব্লেম বা লোগো তৈরী করা উচিত। কাচ্চা বাচ্ছাদের আর্ট কম্পিটিশন এর মতো কম্পিটিশন করে স্টেট্ এমব্লেম বা দাপ্তরিক লোগো বানানো --বড়ই কাঁচা... কাজ। .
0 মন্তব্যসমূহ